
একটু বৃষ্টি হলেই যশোর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় এ ভাবে পানি জমে থাকে। শহরের খুড়কি এলাকার দৃশ্য
বছরের পর বছর জলাবদ্ধতার দুর্বিষহ ভোগান্তিতে যশোর পৌরসভার বাসিন্দারা। সেই দুর্ভোগ থেকে স্বস্তি দিতে প্রতিবছরই নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে পৌরসভা। কিন্তু ফল প্রায় শূন্য। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হচ্ছে শহরবাসীকে। তলিয়ে যাচ্ছে রাস্তা, মার্কেট, অলিগলি। এতে ভোগান্তি বেড়েছে শহরবাসীর। পৌরসভার তথ্যমতে, জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ করে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে তারা। কিন্তু তাতেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি। এবার জলাবদ্ধতা নিরসনের পথ খুঁজতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্পে চোখ। প্রায় দেড় দশকে এত রাস্তাঘাট ও ড্রেনের উন্নয়নের পরও পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় অপরিকল্পিত উন্নয়নকেই দায়ী করছেন সচেতন মহল।
গেল তিন সপ্তাহ উষ্ণতা ছড়িয়ে গত তিনদিন ধরে ভারি ও হালকা বৃষ্টিপাত হচ্ছে যশোরে। বৃষ্টির কারণে শহরের নি¤œাঞ্চলে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। একবার মাঝারি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা দূর হতে সময় লাগে দুই থেকে তিনদিন। ভারি বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা দূর হতে সপ্তাহখানেকও সময় লাগে। কয়েক বছর ধরে চলছে এই অবস্থা। বৃহস্পতিবার সকালে শহরের খড়কি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শাহ আবদুল করিম সড়কের সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এম এম) কলেজের দক্ষিণ ফটক (গেট) থেকে খড়কি মোড় হয়ে পীরবাড়ি, কবরস্থান ও আপন মোড়ে বৃষ্টির পানি জমেছে। ওই এলাকা দিয়ে চলাচলের সময় মাইক্রোবাসের চাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
পায়ের জুতা হাতে নিয়ে অনেককে হেঁটে চলাচল করতে দেখা যায়। ওই এলাকার বাসিন্দা যশোর সরকারি এম এম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহিন বলেন, ‘খড়কি এলাকাটা তুলনামূলক নিচু। রাস্তার পাশে পয়োনিষ্কাশনের নালা দিয়ে অন্য এলাকার পানি আসে। ওই পানি বের হতে পারছে না। পানি জমে থাকায় বিটুমিনের আস্তরণ উঠে রাস্তার মধ্যে বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। পৌরসভার কাছে পানি নিষ্কাশন ও সড়ক সংস্কারের দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। জলাবদ্ধতা এখন এই অঞ্চলের প্রধান সমস্যায় রূপ নিয়েছে। ভারি বৃষ্টি হলে শহরের নিম্নাঞ্চলের রাস্তাসহ আশপাশের এলাকায় পানি ড্রেন উপচে রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাস্তার পানি সহজেই ড্রেনে না পড়া এবং বিভিন্ন ড্রেনের কাজ অসমাপ্ত থাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নাগরিক অধিকার আন্দোলন যশোরের সমন্বয়ক মাসুদুজ্জামান মিঠু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পৌরসভার উন্নয়নে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে শহরে জলাবদ্ধতা দূর হচ্ছে না। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়নের নামে অপচয় করা হয়েছে। ড্রেনগুলো রাস্তার চেয়ে নিচু হয়ে গেছে। এই নাগরিক সমস্যা দূর করতে স্থানীয়দের মতামতের প্রেক্ষিতে হলে এসব সমস্যা দূর হতো। শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটু বৃষ্টি হলেই শহরের অন্তত ১৫টি সড়কে পানি জমে আছে। খড়কি এলাকার শাহ আবদুল করিম সড়ক ছাড়াও শহরের পিটিআই, নাজির শংকরপুর, খড়কি রূপকথা মোড় থেকে রেললাইন, বেজপাড়া চিরুনিকল, মিশনপাড়া, আবরপুর ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, ষষ্ঠীতলাপাড়ার বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়ে পথচারী ও এলাকাবাসী।
জানা যায়, শহরের ভেতর দিয়ে ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নামে দুটি নদ-নদী বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভৈরব নদ দিয়ে শহরের উত্তরাংশ ও মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে শহরের দক্ষিণাংশের পানি নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু গত দেড় দশক শহরের দক্ষিণাংশের পানি মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে নামতে পারছে না। পয়োনিষ্কাশন নালার মাধ্যমে শহরের পানি হরিণার বিল দিয়ে মুক্তেশ্বরী নদীতে যেত। কিন্তু ২০১০ সালে হরিণার বিলে যশোর মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। এরপর আশপাশে আরও অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এতে বিল দিয়ে পানি আগের মতো নিষ্কাশিত হতে পারছে না। ওই পানি বের করার জন্য খালের মাধ্যমে মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু পৌরসভা গত দেড় দশকেও সেই উদ্যোগ নিতে পারেনি।
যশোর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, যশোর শহরে ২৫২ কিলোমিটার পয়োনিষ্কাশন নালা (ড্রেন) রয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ কিলোমিটার আরসিসি, ৬০ কিলোমিটার ইট, পাঁচ কিলোমিটার পাইপ ও ১৩০ কিলোমিটার কাঁচা নালা রয়েছে। এর মধ্যে নগর উন্নয়ন প্রকল্পসহ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে গত ১৪ বছরে ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪০ কিলোমিটার আরসিসি ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে।
যশোর পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা উত্তম কুমার কু-ুু জানান, শহরের একটি অংশের পানি নিষ্কাশন হয় মুক্তেশ^রী নদী দিয়ে। কিন্তু এটির মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাল কেটে এর সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। খালটি স্থানীয়রা দখল করে রেখেছিল। তা উদ্ধার করে সংস্কার করা হচ্ছে। শহরবাসীর অসচেতনতার কারণেও ড্রেনের পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে তিনি মনে করেন তিনি। এ ছাড়াও শহরের অন্য রাস্তা ও নালা সংস্কার ও নির্মাণের জন্য এলজি সিআরআরপি নামে নতুন একটি প্রকল্প পাশ হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শহরের কোনো সড়কেই আর জলাবদ্ধতা থাকবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শরীফ হাসান বলেন, ‘শহরবাসীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল; সেগুলো বাস্তবায়নও করা হয়েছে। তবে শহরবাসীর অসচেতনতার কারণেও নালার পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। রাস্তা ও নালা সংস্কার এবং নির্মাণের জন্য এমজিএসপি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এত কাজের পরও কেন জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না জানতে চাইলে পৌরসভার মেয়র হায়দার গণী খান পলাশ বলেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে আমরা কাজ করছি। মুক্তেশ্বরীর সঙ্গে সংযোগ খাল স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছি। ৪০ কোটি টাকার প্রকল্পটি অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। আগামী নয় আগস্ট তাদের প্রতিনিধি দল আসছে। দ্রুতই প্রকল্পের কাজ শুরু হলে শহরের জলাবদ্ধতা দূর হবে।