ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হলে থাকেন না প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকরা

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ র‌্যাগিং হয় ‘গণরুমে’

আজাহারুল ইসলাম, ইবি

প্রকাশিত: ১১:২২, ৪ মার্চ ২০২৩

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ র‌্যাগিং হয় ‘গণরুমে’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি)। চোখ ভরা স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে এখানে ভর্তি হন শিক্ষার্থীরা। আর এর অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়ে। সামর্থ্য না থাকায় শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই হলে অবস্থান করতে চান। কিন্তু সেই ভাগ্য সবার কপালে জোটে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২৩ শতাংশ আবাসিক সুবিধা রয়েছে। ফলে হলে সিট পাওয়া কঠিন। আর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের তো কল্পনাতীত। তাই অফিসিয়াল ভাবে না হলেও প্রতিটি হলে তৈরি করা হয়েছে গণরুম। যার অধিকাংশই ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করেন।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যলয়ের মোট আটটি হলের প্রতিটিতেই গণরুম রয়েছে। এসব গণরুমে সাধারণত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উঠানো হয়। গণরুমে জায়গা পেতেও ছাত্রলীগের ‘বড়ভাই’ দের রেফারেন্স প্রয়োজন পড়ে। আর হলে ওঠার সাথে সাথেই শুরু হয় ম্যানার শেখানোর নামে র‌্যাগিং। মাঝেমধ্যে র‌্যাগিং সীমা ছাড়িয়ে যায়। র‌্যাগিংয়ের নামে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ছাড়াও মারধর, চড়-থাপ্পড়, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, যৌনকর্মী হিসেবে অভিনয়, হিজড়ার মত অভিনয়, ময়লা গ্লাস চাটানো, ম্যাচের কাঠি দিয়ে ঘর পরিমাপ, ছেলে/মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ানো, জোরপূর্বক মাদক গ্রহণ, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রাখা, ক্রমাগত সালাম দেওয়ানো হয়। এছাড়া ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনাও ঘটে।

র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় যারা জড়িত থাকেন তারা অধিকাংশই ইমিডিয়েট সিনিয়র। তারা প্রথম বর্ষে থাকাকালীন র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়। ফলে পরবর্তী ব্যাচ আসার সাথে সাথেই ঝাপিয়ে পড়ে। পরিচিত হওয়া বা ম্যানার শেখানোর নামে এসব অত্যাচার করা হয় বলে জানান ভূক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, শ্রেণিকক্ষেও পরিচিত বা ম্যানার শেখানোর নামে র‌্যাগিংয়ের শিকার হন নবীন ছাত্ররা।

র‌্যাগিংয়ে ফলে অনেক শিক্ষার্থী শারীরিক ভাবে অসুস্থ্য ও মানসিক ভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়েন। এর ফলে ক্যাম্পাস ছাড়ারও নজীর রয়েছে। এর এই র‌্যাগিং বৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিচারহীনতা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে র‌্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিলে নামমাত্র তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই কমিটি আর আলোর মুখ দেখেন না। ফলে অভিযুক্তদের সাহস আরো বেড়ে যায়।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থী এবং একই বছরের ১৯ মার্চ ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। তারা সকলেই ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এরপর আর এমন নজির দেখা যায়নি।

এছাড়াও র‌্যাগিংয়ের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বড় ভাইদের ভয়ে অভিযোগ করতে সাহস করেন না নবীনরা। কারণ তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি নিয়ে অনুগত করে রাখা হয়। আর অভিযুক্তদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের ছত্রছায়ায় তারা দিনে দিনে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠছেন। জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন অপরাধেও। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও বেশি কিছু করতে দেখা যায় না। সাধারণত প্রভাব খাটানোর জন্য র‌্যাগিং দিয়ে থাকেন সিনিয়র শিক্ষার্থীরা। তবে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্য থাকে দল ভারি করা।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কমিটি থাকলে সাধারণ সময়ের চেয়ে অপধারের মাত্র বেড়ে যায়। ২০১৭ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলা বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শাহিনুর রহমান শাহিনকে সভাপতি এবং একই বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র জুয়েল রানা হালিমকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর বেশ কয়েকটি র‌্যাগিংয়ের ঘটনা সামনে আসে। এছাড়া ২০১৮ সালের অক্টোবরে টর্চার সেল গঠন করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা সহ বিভিন্ন কারণে কমিটি স্থগিত হয়। কমিটি স্থগিতের পর শিক্ষার্থী নির্যাতনের খবর কমতে থাকে।

সর্বশেষ গত ৩১ জুলাই আইন বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতকে সভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের নাসিম আহম্মেদ জয়কে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দেয় কেন্দ্র। এরপরই সম্প্রতি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ক্লাস শুরুর হলে র‌্যাগিংয়ের ঘটনা শোনা যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে অভিযোগ দেন না ভূক্তভোগীরা। সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে বিবস্ত্র করে রাতভর এক ছাত্রীকে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল করার হুমকির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এই অভিযোগের তীরও ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে। যা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

র‌্যাগিংয়ের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের হলে তদারকি না করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি আবাসিক হলের প্রভোস্টদের কেউই দাপ্তরিক সময়ের বাইরে ক্যাম্পাসে থাকেন না। এছাড়া আবাসিক শিক্ষক থাকলেও তাদেরকে মাঝে-মধ্যে হলে গিয়ে হলের প্রশাসনিক কিছু কাজের বাইরে তেমন কিছু করতে দেখা যায় না। তথ্য মতে, প্রভোস্টদের অর্ধেক কুষ্টিয়া ও অর্ধেক ঝিনাইদহ শহরে বসবাস করেন। এছাড়া মোট ৪৪ জন আবাসিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র আটজন ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকায় থাকেন। বাকিরা থাকেন পাশ্ববর্তী দুই জেলা শহরে। ফলে হলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা।

প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ড. দেবাশীষ শর্মা বলেন, এটা আমরা অস্বীকারও করি না আবার সমাধান করাটাও কঠিন। শিক্ষকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ অন্য সুযোগ সুবিধাগুলো ক্যাম্পাসের আশেপাশে নাই। তবে আমরা কয়েকদিন আগে প্রভোস্ট কাউন্সিলের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিটি হলে প্রভোস্টদের সপ্তাহে একদিন রাত আটটা পর্যন্ত অফিস করতে হবে।

হলে নেতা-নেত্রীদের দাপটের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা যে এত প্রকট তা শেখ হাসিনা হলের ঘটনার পর ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি। ছাত্রসংগঠনগুলোকে এ ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে এবং ভয়ের পরিবর্তে ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন জয়ের চেষ্টা করতে হবে।

র‌্যাগিংয়ের আরেকটি সূত্রপাত হয় ক্লাস রুম থেকে। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে নবীনদের ক্লাসরুমে শুরু হয় র‌্যাগিং। এমনকি শিক্ষককে ক্লাসরুম থেকে বের করে দিয়ে র‌্যাগিংয়ের ঘটনার নজীর আছে ইবিতে। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমন একটি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এর পিছনে শিক্ষকদের ক্লাসরুম মনিটরিং না করাকে দায় করছেন সকলেই।

ছাত্র ইউনিয়ন ইবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক মুখলেসুর রহমান বলেন, ইবির ছাত্রী হলে নবীন ছাত্রীকে ছাত্রলীগ নেত্রী ও তার সহযোগীদের নির্যাতন বর্বরতার এক চিত্র। এমন ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। নতুবা বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। অতীতেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ছাত্রী হেনস্তার বিচার হয়নি। ফলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। আবাসিক হলগুলোর গণরুম নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। এর মূলে প্রভোস্টদের দায়িত্বহীনতা। তারা গণরুমগুলো তদারকি করতে ব্যর্থ। পরোক্ষভাবে এগুলোর দায়িত্বে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন। এসব ঘটনায় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। ছাত্র ইউনিয়ন ইবি সংসদ বরাবরই  এসব ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলন করেছে।

শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দীকী আরাফাত বলেন, আমরা তো প্রচার প্রচারণা কম চালাচ্ছি না। জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এরপরেও যে ঘটনা ঘটে সেগুলো অনাকাক্সিক্ষত ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। গণরুম ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে কি-না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, গণরুম কালচার জিনিসটা খারাপ। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সংখ্যক সিট না থাকার কারণে গণরুম গড়ে ওঠে। এই দায় অবশ্যই প্রশাসনের। তারা শিক্ষার্থীদের আবাসিকতা নিশ্চিত করতে পারছে না।

অপরাধের ক্ষেত্রে ঘুরে-ফিরে ছাত্রলীগের নাম আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের নাম আসে কারণ ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে আছে। অন্য সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে সেভাবে নেই। ছাত্রলীগ র‌্যাগিংয়ের সাথে জড়িত ঘটনাটা এমন না। যারা অসুস্থ মস্তিষ্কের ব্যক্তি তারা ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য র‌্যাগিং নামক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটায়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অপরাধীদের ব্যাপারে সাংগঠনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার রেকর্ড আছে। যদি কারো সাথে এমন ঘটনা ঘটনা ঘটে সরাসরি আমাকে অথবা সাধারণ সম্পাদককে জানালে আমরা ব্যবস্থা নেব। অভিযোগকারীর নাম পরিচয় গোপন থাকবে। 

সাবেক প্রক্টর ও আইসিটি বিভাগের অধ্যাপক ড. পরেশ চন্দ্র বর্মন বলেন, যে যার দায়িত্বে আছে সে তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। দায়িত্ব পালন করলেই যে এটা বন্ধ হয়ে যাবে তা না। কিন্তু বন্ধ করার জন্য তো প্রচেষ্টা করতে হবে। একটা ভ্রান্ত সংস্কৃতির মধ্যে আমরা পড়ে আছি। এখানে জীবন নিয়ে উদাসীনতার প্রভাব আছে একটা। কোনো ক্ষমতাসীন দলের প্রকৃত কোনো কর্মী, যার মধ্যে প্রকৃত চেতনা থাকে, তার দ্বারা এটা করা সম্ভব না। একমাত্র ভ্রান্ত চেতনায় বিশ্বাসী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরাই এমন ঘটনা ঘটায়।

তাসমিম

×