
মোফাজ্জল হোসেন বান
দেশমাতৃকার স্বাধিকার আন্দোনের বীর সেনানী একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বানু। রণাঙ্গনে তিনি সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে গুলি চালিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে বোমা ছুড়েছেন, পাকা ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। শত্রু নিধন করতে গিয়ে বাঁশঝাড়ে মশার কামড় খেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতি মনে হলে আজো তার গা শিউরে ওঠে।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন বানু বলেন, ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে প্রথম অপারেশন করি লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা সীমান্ত চৌকিতে। সিরাজগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কালু, আলতাফ, তোজাম ও সামাদসহ সাতজন আমরা একই গ্রুপে ছিলাম। গ্রুপের অন্যরা ছিলেন অন্যান্য জেলার।
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের নিয়ন্ত্রণে অপারেশন চালাই। আমাদের প্রথম কাজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীকে ডিস্টার্ব করা অর্থাৎ ‘হিট অ্যান্ড রান।’
তিনি বলেন, দিন-তারিখ মনে নেই। তবে এটুকু মনে পড়ে, সময়টা ছিল সেপ্টেম্বর মাস। হাতিবন্ধা সীমান্ত চৌকিতে পাকিস্তানিদের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে পাহারারত এক সেনা সদস্যকে এসেলারের গুলিতে হত্যা করি। গুলি পাহারারত ওই পাকসেনার থুতনির নিচ দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। ধপাস করে পড়ে যায় মাটিতে। সে মুহূর্তটা ছিল বড়ই আনন্দের। পুলকিত হয়ে উঠেছিলাম। ভেতরে ভেতরে কী যে অনুভূতি, তা প্রকাশ করা কঠিন। তবে বাঁশঝাড়ের মধ্যে মশার কামড় সহ্য করে গুলি চালিয়ে পাকসেনাকে হত্যার কষ্টটাও কম ছিল না। এরপর ফিরে যাই বিএসএফ ক্যাম্পে।
সীমান্ত এলাকার যুদ্ধ খুবই কঠিন কাজ ছিল। প্রতিদিনই কৌশল পাল্টাতে হয়। পাকিস্তানি সেনারা সীমান্ত নিজেদের দখলে রাখতে চায়, বিএসএফ চায় নিজেদের দখলে নিতে। আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিএসএফকে সহযোগিতা করেছি। কৌশল পাল্টে সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই যুদ্ধে অংশ নিয়েছি, পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের আতঙ্কে রেখেছি। এই সীমান্তে বিএসএফের নির্দেশে আমরা পাকিস্তানি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে প্রতি সপ্তাহে ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে হামলা চালাই। আমাদের এ ধরনের হামলায় পাকসেনার বিব্রত এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সুযোগ পেলেই হামলা চালানো হতো।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, যতদূর মনে পড়ে দুটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে এক স্থানে ১৪ পাকসেনা এবং অপর এক স্থানে ১১ পাকসেনাকে হত্যা করি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মধ্যে তিন থেকে চার মাস যুদ্ধ করেছি সীমান্ত এলাকায়। আমার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আমির হোসেন। তার নেতৃত্বে রওনা হই চুনিরহাট-ডাঙ্গারহাট সড়কে। সেই সড়কের দুটি কংক্রিটের ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সেটা ছিল অক্টোবরের প্রথমার্ধে। এরপর যুক্ত হই রংপুরের সন্তান কমান্ডিং অফিসার স্বপন সাহেবের সঙ্গে। সীমান্ত ছেড়ে আমরা ধীরে ধীরে দেশের ভেতরে প্রবেশ করি। আমাদের গ্রুপ সব সময় সেকেন্ড পার্টি হিসেবে কাজ করেছে। কোথাও সম্মুখযুদ্ধ হলে আমরা ফার্স্ট পার্টিকে প্রটেকশন দিয়েছি। যখন যুদ্ধ শেষ তখন আমরা বগুড়ায়।
তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়নের মেছড়া গ্রাম যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলে অবস্থিত। সেই চরে মায়ের কাছে দোয়া নিয়ে রওনা হই যমুনা নদীপথ ধরে ভারতের উদ্দেশে। প্রথমেই কুড়িগ্রামের রৌমারী, এরপর ১০৪ জনের একটি দল নিয়ে পৌঁছাই দার্জিলিংয়ে। সেখানে মুক্তিনালা ক্যাম্পে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ নেই ভারতের সেনাবাহিনীর কর্নেল প্রিন্স চৌহানের নেতৃত্বে। প্রশিক্ষক ছিলেন প্রেমাংশু। ২৮ দিনের এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আমার জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা।
বয়সে কিশোর হলেও পরিপূর্ণ একজন মানুষের মতো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সময় কাটাতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে হতাশ হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা, বাঙালির পরাধীনতার শৃক্সঙ্খল ভাঙার দৃঢ় প্রত্যয় সাহস জুগিয়েছে। সব কষ্ট ভুলে অমিত সাহস নিয়ে যুদ্ধ করেছি বিভিন্ন এলাকায়। দেশ স্বাধীন হলে নয় মাসের সব কষ্ট ভুলে যাই।