ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

আক্রমণে টিকতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালায় পাকসেনারা

সৈয়দ হুমায়ুন পারভেজ শাব্বির, শাহজাদপুর

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আক্রমণে টিকতে না পেরে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালায় পাকসেনারা

মো. আব্দুল হাই

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা নিরীহ বাঙালিকে নানাভাবে শোষণ করে আসছিল। তাদের বৈষম্য আর অত্যাচারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় বাঙালির। নিষ্পেষিত বাঙালির কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে বাঙালি। অনেক ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের উল্টাডাব গ্রামের হাজী আব্দুল গফুরের (মৃত) ছেলে মো. আব্দুল হাই তাদেরই একজন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল হাই বলেন, ১৯৭১ সালে আমি শাহজাদপুর কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। তখন আমার বয়স ২০ বছর। পরিবারকে না জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ৮ মার্চ ১৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে পোরজনায় যুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু করি। পরবর্তীতে আরও ১৫ যোদ্ধাসহ ৩০ জন যুবক নিয়ে শাহজাদপুর গার্লস হাইস্কুলে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ শুরু করি।

এই প্রশিক্ষণে সাবেক গণপরিষদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান নানাভাবে সহযোগিতা করেন এবং ২৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরবর্তীতে এমসিএ আব্দুর রহমানকে জলঙ্গী ক্যাম্পের ইনচার্জ করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল হাই বলেন, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনার নগরবাড়ীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করি। প্রথমে পাকবাহিনী আকাশ থেকে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। এতে ইপিআর, আনসার সদস্য ও সহযোদ্ধারা পালিয়ে যায়। পাকবাহিনী আরিচা ঘাট থেকে নগরবাড়ী ঘাট লক্ষ্য করে ব্যাপক মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। ফলে পুরো এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পরের দিন পাকবাহিনীর একটি বিশাল দল ফেরিতে করে নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান করে এবং ব্যাপক আক্রমণ চালায়। নগরবাড়ীতে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।

আমিসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একটি আধাপাকা ঘরে অল্প সংখ্যক গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান করে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখি। কিন্তু পাকবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সামনে পিছু হটতে বাধ্য হই। পরে, সুযোগ বুঝে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে অনেক আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। আমরা সেসব অস্ত্র সংগ্রহ করি।

কিন্তু এসব আধুনিক অস্ত্র সে সময় সবাই চালাতে পারত না। তখন রফিকুল ইসলাম বকুল এ অস্ত্র চালানোর দায়িত্ব আমাকে দেন। যুদ্ধের ৯ মাসে মুলাডুলি, ধানাইদহ, বিড়ালদহ ও নাটোরসহ ১২ স্থানে পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই মর্টারশেলের আঘাতে গুরুতর আহত হই।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, দেশে যুদ্ধের একপর্যায়ে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের বালুরঘাটে চলে যাই। সেখান থেকে নদীয়া জেলার করিমপুর থানার কেয়াডাঙ্গা হাইস্কুল ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিই। পরে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি। ওই ক্যাম্পে অবস্থানকালে আমার শরীরে থাকা মর্টারশেলের স্পিøন্টার বের করা হয়। জুলাই মাসে কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি এবং সেখান থেকে বিমানে করে উত্তরপ্রদেশ ও দেরাদুনে চলে এসে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিই।

প্রশিক্ষণ শেষ করে শাহজাদপুরে চলে আসি এবং ১০ জনের একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করি। ধীতপুরে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করি। এই যুদ্ধে কয়েকজন রাজাকারকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে একটি ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। এর আগে এই রাজাকাররা পাক হানাদারদের দোসর হিসেবে কাজ করে এবং গ্রামে গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ করে। তারা বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য সর্বদাই ওত পেতে থাকত।
১৯৭০ সালের জুন মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের একটি মিটিংয়ে নিজ হাতে ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়ার কথা গর্বভরে স্মরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

×