ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলে হার মানে পাকিবাহিনী

আবু কায়সার শিপলু, গাইবান্ধা

প্রকাশিত: ০০:০৯, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩

মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলে হার মানে পাকিবাহিনী

ফুল মিয়া

একাত্তরের নয়মাস অনেকের মতো আমিও প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন বািজ রেখে যুদ্ধে নেমেছিলাম। তখন আমার সামনে ছিল অনিশ্চয়তার অন্ধকারের পাশাপাশি যুদ্ধজয়ের নেশা। প্রতি মুহূর্তের চিন্তাই ছিল কিভাবে শত্রু নিধন করব। আজ যখন সেসব দিনের কথা মনে করি, তখন শিউরে উঠি। কি অসম যুদ্ধেই না নেমেছিলাম আমরা। সেই সময়কার অনেক ঘটনাই আজ আর মনে নেই। ভুলে গেছি অনেক সহযোদ্ধার নামও। যুদ্ধ স্মৃতি নিয়ে ‘একাত্তরের নয়মাস’ নামে একটি বই লিখতে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করছি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে এসব কথা বলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আনোয়ারুল কাদির ফুল মিয়া।
একাত্তর সালে তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমা শহরের বয়েজ কলেজের বিএ ১ম বর্ষের ছাত্র ছিলেন মো. আনোয়ারুল কাদির ফুল মিয়া। সরাসরি ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও ছাত্রলীগের নানা সংগ্রামের বলিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতের পর গাইবান্ধার চালচিত্র স¤পূর্ণ বদলে যায়। এর কয়েকদিন পর প্রতিবেশী বন্ধু তরু এসে ফুল মিয়াকে জানায়, গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মাহাবুব, বাদল, কাজিউল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

পরদিনই ২৭ মার্চ ফুল মিয়া অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য কলেজ মাঠে যান। এখানে কাঠের রাইফেল দিয়ে রাতে প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দিনরাত একটানা প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ চলাকালে ১০ এপ্রিল নির্দেশনা এলো, পলাশবাড়ীতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের আফতাব সুবেদারের রংপুর-বগুড়া সড়কের পাশে একটি ডিফেন্স আছে। বিকেলের মধ্যেই ওই ডিফেন্সে যোগ দিতে হবে। ফুল মিয়ার মনে তীব্র উত্তেজনা। দ্রুত তিনি বাড়ি গিয়ে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে থানার সামনে চলে আসেন। এখানে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

ফুল মিয়া দেখেন দুলু, রঞ্জু, তরু, সুফী, বুলবুলসহ মাহাবুব ভাই, কাজিউল ভাই, বাদল, অপু, আফতাব হোসেন, আলতাব হোসেন, মিন্টু ভাই মিলে ৩৫ জনের একটি দল প্রস্তুত। অ্যাডভোকেট টুলু ভাই ট্রেজারি থেকে কিছু রাইফেল এনে দিলেন। তাই নিয়ে ট্রাকটি পলাশবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছান বিকেলে। পলাশবাড়ী সড়ক ও জনপথ অফিসের কিছু উত্তরে রংপুর-বগুড়া হাইওয়ের পূর্বপাশে একটি বড় পুকুরপাড় ঘেঁষে বাংকার করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য ও কিছু ইপিআর সৈন্য নিয়ে আফতাব সুবেদার ডিফেন্স গড়েছেন।

ফুল মিয়াসহ গাইবান্ধা থেকে সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা আফতাব সুবেদারের নির্দেশমতো যুদ্ধে অংশ নেন। এখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মজিদ নামের একজন সৈনিক ফুল মিয়াসহ গাইবান্ধার সকল মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধের কৌশল ও অস্ত্র চালনা স¤পর্কে তৎক্ষণিক ধারণা দেন। ফুল মিয়ার মুক্তিযুদ্ধের হাতেখড়ি এই পলাশবাড়ীতেই। ১৬ এপ্রিল সকালে আফতাব সুবেদার পলাশবাড়ী থেকে ডিফেন্স তুলে নিয়ে মাদারগঞ্জে যান।

মাদারগঞ্জহাটের বাইরে একটা লম্বা বাঁশঝাড়ের ভেতর বাংকার করেন। এ সময় মাদারগঞ্জের গ্রামবাসী তীর-ধনুক, লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ায়। খুব ভোরে পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাঙ্ক নিয়ে হাজির হয় মাদারগঞ্জে। পাকিসেনাদের ভারি অস্ত্রের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের অসমযুদ্ধ। বড় রাস্তার পাশে ব্রিজের কাছে পাকিসেনাদের গাড়িবহর আসামাত্রই আফতাব সুবেদারের প্রতিরোধের নির্দেশ। মুহূর্তেই গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান, এলএমজি আর পজিশন নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থাকা থ্রি নট থ্রি রাইফেল। শুরু হলো প্রচ- লড়াই। পাকসেনারা বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ শুরু করে।
ওদের অস্ত্রের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে পারছিলেন না। ফুল মিয়া মনে মনে ভাবলেন, এই যুদ্ধেই বুঝি প্রাণ থাকে না। কিন্তু আফতাব সুবেদারের বুদ্ধিদীপ্ত যুদ্ধ কৌশল মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে আফতাব সুবেদারের নির্দেশ এলোÑ কৌশলে পিছু হটতে হবে। শত্রু সেনাদের বোকা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে।

একটি বাংকার থেকে হেভি মেশিনগানের গুলিবর্ষণ চলতে থাকল। ইপিআরের পারদর্শী মজিদসহ তিন মুক্তিযোদ্ধা এলএমজি জায়গা বদল করে গুলি ছুড়তে থাকল। আফতাব সুবেদার আরও একটি নির্দেশ দিলেন, ট্রাক স্টার্ট হওয়ার জোড়ে শব্দ হবে; সেই শব্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রাকের কাছে যাবে। তবে চারটি রকেট লঞ্চার ছোড়ার শব্দ হবার পর।

কথামতো রকেট লঞ্চার ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একযোগে দৌড়ে ট্রাকে উঠে পড়ে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। জোরে ট্রাক স্টার্টের শব্দ আর পর পর চারটি রকেট লঞ্চারের শব্দে শত্রু সেনারা ভাবল মুক্তিযোদ্ধারা আরও অস্ত্র, গোলা বারুদসহ তাদের প্রতিরোধে এসেছে। তৎক্ষণাৎ পাকিসেনারা ট্যাঙ্কের মুখ ঘুরিয়ে পিছু হটে।

×