স্বাধীনের বয়স আট বছর। তার ছোট বোন সাদিয়ার বয়স চার বছর। বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বোরাদী গরঙ্গল গ্রামে। দু’জনেই মোবাইল ফোনে ডাউনলোডকৃত গোপালভাঁড় দেখায় ব্যস্ত। এ সময় তাদের কাকা ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরে ঘরে প্রবেশ করে। অনেক ডাকাডাকির পরেও তারা কাকার কাছে আসেনি। ওরা মোবাইল ফোনে গোপালভাঁড় দেখতে ব্যস্ত। এভাবেই মোবাইল ফোনের আসক্তির ফলে পারিবারিক বন্ধন হালকা হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। ওদের মতো গ্রামীণ শিশুদের মাঝে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মোবাইল ফোন আসক্তি।
খেলাধুলার পরিবর্তে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখা ও গেমসের প্রতি ঝুঁকছে গ্রামের শিশুরা। সাধারণত গ্রাম অঞ্চলে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক দুর্বল। ফলে সরাসরি ইন্টারনেট থেকে কোন কিছু ডাউনলোড করার ক্ষেত্রে বেগ পেতে হয় ব্যবহারকারীদের। এ সুযোগে গ্রামীণ হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে গান ভিডিও লোডের দোকান। যেসব দোকানে উচ্চ শব্দে সারাদিন গান চালানো হয়। ওই দোকানগুলোতে একটি কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে স্বল্প বয়সী দোকানি। সেখানে গান, গেমস, কার্টুনসহ বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়াল মেমোরি কার্ডে লোড করে দেয়া হয়। প্রতি গিগাবাইট ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে লোড করা হয়। এসব দোকানিকে আপডেটেট সব গান, গেমস, কার্টুনসহ ভারতীয় সিরিয়াল সরবরাহ করে বিভাগীয় শহরের ব্যবসায়ীরা। গ্রামীণ ব্যবসায়ীরা এক শ’ জিবি ডাটা এক থেকে দেড় শ’ টাকায় কিনে থাকে বলে জানিয়েছেন লোড ব্যবসায়ীরা। তারা আরও জানায়, অভিভাবকরা শিশুদের শান্ত রাখার জন্যই দোকানে এসে পটল কুমার গানওয়ালা, রাখি বন্ধন, আহট, গোপালভাঁড়, মোটুপাতলু, চাঁদের বুড়ি, ডরিমনসহ বিভিন্ন সিরিয়াল লোড করে দিতে বলে। ফলে ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে দেশীয় সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে গ্রামীণ শিশুরা। শিশুদের খাওয়া, ঘুম ও গোসলের সময় মোবাইল ফোনে পছন্দের ভিডিও চালিয়ে রাখতে হয়। না হলে কোন কিছুতেই সায় দেয় না মোবাইল ফোন আসক্ত শিশুরা। আমেনা নামের এক শিশুর মা বলেন, আমার সন্তান কার্টুন না চালিয়ে দিলে ভাতই খায় না।
পড়ালেখার পাশাপাশি বিনোদন খুবই জরুরী। মোবাইল আসক্তির ফলে খেলাধুলা বা শারীরিক কসরত ব্যাহত হচ্ছে। মোবাইল ফোনে গেমস খেলা বা বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখে সময় নষ্ট করছে এসব শিশু। তাই চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সচেতন মহল।
গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শরীফ আহম্মেদ বলেন, বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে শিশুরা। এটি বন্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয়ভাবে কোন স্কুলে যাতে শিক্ষার্থীরা ফোন ব্যবহার না করতে পারে, সেজন্য আমার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আগামীতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ সভার আয়োজন করা হবে।
গৌরনদীর শতবর্ষী গেরাকুল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কচি বেগম জানান, শিশুদের মোবাইল আসক্তির ফলে লেখাপড়ার ওপরে প্রভাব পড়েছে। অনেক শিশু শিক্ষার্থী হোম ওয়ার্ক ঠিকভাবে করে না। অধিকাংশ সময় মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে এমন অভিযোগ আমাদের কাছে অনেক। আবার খেলাধুলাও ঠিকভাবে না করার ফলে শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ জয়নাল আবেদীন খান জানান, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার শিশুদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। খুব কাছ থেকে ভিডিও দেখা কিংবা গেমস খেলার ফলে শিশুদের চোখের সমস্যার সৃষ্টি করে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক রেডিয়েশন মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া অন্যমনস্ক হয়ে খাবার খেলে বদহজম হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই শিশুদের খাওয়ার সময় মোবাইল ফোন বা টিভি না দেখাই ভাল। শিশু রোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি অনেকটাই দায়ী। উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, গত কয়েকদিন পূর্বে মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত গেমস খেলার কারণে গেরাকুল মহল্লার এক প্রবাসী তার পুত্র শারীরিক সমস্যায় পরলে স্বজনরা তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে শিশু আদিল আকন গভীর রাত পর্যন্ত এক কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে গেমস খেলার কারণে তার ঘাড়ের একটি রগে ভীষণ সমস্যা হয়েছে।
পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এজন্য তিনি অভিভাবকদের বেশি করে সন্তানদের সময় দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য খেলাধুলার ব্যবস্থা করা দরকার। যতটা সম্ভব মোবাইল ফোন থেকে শিশুদের দূরে রাখাই ভাল। তাই অভিভাবকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরী।
-খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে