ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সঠিক প্রক্রিয়ায় কঠোর তদারকিতে প্যাকেজ বাস্তবায়ন দাবি

প্রকাশিত: ১০:২৬, ৬ এপ্রিল ২০২০

 সঠিক প্রক্রিয়ায়  কঠোর তদারকিতে  প্যাকেজ  বাস্তবায়ন  দাবি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় প্রায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার পাঁচটি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ প্যাকেজকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষক, গবেষক ও খাত সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি সঠিক প্রক্রিয়ায় কঠোর তদারকির মাধ্যমে এ প্যাকেজ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন তারা। তা না হলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে তারা মনে করেন। পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা দেয়া হয়েছে, যা জিডিপির ২.৫২ শতাংশ। রবিবার সকালে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারী এ ভাইরাসে সৃষ্ট সঙ্কটে দেশের অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলো তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি সঙ্কট উত্তরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোসহ চারটি কার্যক্রম নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন তিনি। এর আগে আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় বিভিন্ন প্রণোদনাসহ নীতি সহায়তার দাবি জানায় দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক সংগঠন। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ‘প্যাকেজগুলো খুবই প্রয়োজন’ উল্লেখ করে একে স্বাগত জানিয়ে এর সঠিক বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের এসব তহবিল বাস্তবায়ন করবে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারা যেন ছোট-বড় উদ্যোক্তার সমন্বয় করে সঠিক নিয়মে ঋণ সহায়তা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলার জন্য ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানের সহায়তা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যেসব প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন এটি বাস্তবসম্মত। এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। তবে আশঙ্কা রয়েছে এটি বাস্তবায়ন নিয়ে। কারণ, এসব তহবিলের অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ হিসেবে দেবে বিতরণের জন্য। বলা হয়েছে, ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতেই ঋণবিতরণ করবে ব্যাংকগুলো। এখন ব্যাংক কাদের ঋণ দেবে, এটা দেখার বিষয়। যাদের ঋণ দেবে তারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কিনা? এই বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরী’ বলেন তিনি। ‘করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকের আমানত কমে যাবে। ফলে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমবে। এ অবস্থায় ঋণ বিতরণ কিভাবে করবে। তহবিলের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে কোন ধরনের নিয়মনীতি কি করা হচ্ছে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।’ এটি ভালভাবে বাস্তবায়নের জন্য সঠিক নীতি ও তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ। একই ধরনের পরামর্শ দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এই প্যাকেজে বড় শিল্পের জন্যই বেশি বরাদ্দ রয়েছে। তবে এসএমইর (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল রয়েছে, এটা ভাল। কিন্তু এ তহবিলের ঋণ বাস্তবায়নের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। এখন তারা কিভাবে তা পালন করবে, এটাই দেখার বিষয়। কারণ, বড় শিল্প সবসময় বড় অঙ্কের ঋণ নেয়। ব্যাংকগুলোও ওসব ঋণ দিতে বেশি আগ্রহ দেখায়। ফলে সবসময় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বঞ্চিত হয়। তাই ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা যেন ঋণ পান, এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে। পাশাপাশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা সঠিক পরিমাণে ঋণ পাচ্ছে কিনা, এটাও দেখভাল করতে হবে’ বলছিলেন তিনি। ‘এসএমই খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এ সুদহার আরও কম দেয়া গেলে বেশি ভাল। প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজ ঘোষণায় বড় শিল্পের প্রণোদনা থাকলেও কৃষি ও খাদ্য নিশ্চিতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা প্রয়োজন ছিল। এ পরিস্থিতিতে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বেশি জোড় দিতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এটি না পারলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন হলে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে সঠিক নির্দেশনা দেয়া জরুরী।’ এ সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক লোকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার দাবি জানিয়ে সাবেক এই গবর্নর বলেন, ‘যারা প্রাতিষ্ঠানিক তারা বেশকিছু সুবিধা পাবেন। তবে এখন সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় থাকা ছিন্নমূল অপ্রাতিষ্ঠানিক লোকদের বিষয়ে আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারের উচিত সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো। কারণ, এখন যে ১২ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ আছে, তা খুবই সামান্য। এটি শীঘ্রই বাড়ানো দরকার।’ সহজ নিয়মে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই উদ্যোক্তারা যেন এ ঋণ পান, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা চেয়েছেন এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে করোনার আর্থিক ক্ষতি নিয়ে একটি জরুরী বৈঠক হয়। সেখানে এসএমই খাতের বিভিন্ন ক্ষতি তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত এসএমইর জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ঘোষণা করেছেন। এটা খুবই ভাল খবর।’ ‘কিন্তু এই তহবিল থেকে ঋণ প্রদান করবে ব্যাংকগুলো। আমরা চাই, ব্যাংকগুলো সহজে সঠিক নিয়মে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই উদ্যোক্তাদের এই ঋণ প্রদান করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যেন এ বিষয়ে একটি সহজ নীতিমালা করে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। যাতে এ মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্তরা সহজে ঋণ পান। কারণ, অতীতে আমরা দেখেছি, ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গিয়ে সহজে ঋণ পায় না। এতে তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।’ প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা তুলে ধরে এসএমই ফাউন্ডেশনের এমডি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, মহামারীর আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের দেশের পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং এটি ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়টি আমাদের সবার নজর দেয়া উচিত। কারণ, আমরা সবসময় দেখি, আমাদের বিভিন্ন উৎসবে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক পণ্য আমদানি হয়। যদিও সে সব পণ্য আমাদের দেশেই তৈরি হয়। এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগামীতে এসব পণ্য যেন না আসে (বিদেশ থেকে) এটা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কলকাতা, থাইল্যান্ড দিয়ে আমাদের যে কেনাকাটা করার মনমানসিকতা আছে, দেশীয় শিল্প রক্ষায় এটি পরিবর্তন করা উচিত।’
×