ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর বিকল্প চিন্তা আয়োজকদের

পহেলা বৈশাখে ঘরে বসেই হবে বাঙালিত্বের সাধনা

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১ এপ্রিল ২০২০

পহেলা বৈশাখে ঘরে বসেই হবে বাঙালিত্বের সাধনা

মোরসালিন মিজান ॥ শেষতক পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালো করোনাভাইরাস। বাঙালীর সবচেয়ে বৃহৎ বর্ণাঢ্য এবং অসাম্প্রদায়িক উৎসবটি এবার আর হচ্ছে না। ঘরে বসেই হবে বাঙালিত্বের সাধনা। সবাই মিলিত হওয়ার পরিবর্তে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জীবন ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতির চর্চা করবেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর বাংলা নববর্ষবরণ উৎসব না করার প্রস্তাবের বিপরীতে এমন চিন্তার কথা জানিয়েছে ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ও প্রধান প্রধান আয়োজকরা। আর মাত্র কয়েকদিন পর বাংলা নববর্ষ। এবার ১৪২৭ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বাঙালী। বরাবরের মতোই আগেভাগে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেনি। কোভিড ১৯ ভাইরাসের হুমকির মুখে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। এ অবস্থায় মঙ্গলবার বর্ষবরণ উৎসব না করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাব দেন। আয়োজকদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, নববর্ষের অনুষ্ঠান আমি মনে করি ডিজিটাল পদ্ধতিতেই আপনারা করতে পারেন। সেখানে সবাই যথাযথ আকারে করুন। কিন্তু বিশাল জনসমাগম করে এই অনুষ্ঠান সারাদেশে সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হবে। এটা আমার বিশেষ অনুরোধ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কষ্ট বেশি লাগছে আমার। মানুষের কল্যাণের দিকে তাকিয়েই কিন্তু এটা আমি বন্ধ রাখছি। কাজেই নববর্ষের অনুষ্ঠান আপনারা করবেন না। এটা আপনারা মনে রাখবেন। অবশ্য এরও আগে থেকে বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে কথা হচ্ছিল। সব আয়োজন বন্ধ থাকবে? নাকি বিকল্প কোন চিন্তা নিয়ে কাজ করার আছে? এমন নানা প্রশ্ন যখন উঁকি দিচ্ছিল তখন উত্তর খুঁজে পাওয়া গেল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। বর্ষবরণ উৎসবের প্রধান প্রধান আয়োজক, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতিকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, মানুষের জন্যই সব। সেই মানুষকে বাঁচাতে এবার উৎসব আয়োজন বন্ধ রাখার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক ছায়ানট। বাঙালী সংস্কৃতির অব্যাহত চর্চা ও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিপুল ভূমিকা রেখে চলা প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ সকালে রমনা বটমূলে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু এবার ভিন্ন বাস্তবতার কারণে সে ধরনের উদ্যাপনে যাবে না ছায়ানট। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বিকল্প চিন্তা করছে প্রগতিশীল এ প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে জানতে মঙ্গলবার কথা হয় ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুনের সঙ্গে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জনকণ্ঠকে বলেন, পহেলা বৈশাখ বাঙালীর সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। প্রতি বছরের মতো আগেভাগেই এ উৎসব উদ্যাপনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা। পহেলা বৈশাখ ভোর বেলায় রমনায় গাওয়ার জন্য ছেলে মেয়েরা মহড়া করছিল। কিন্তু এরই মাঝে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। হুমকিতে পড়ে যায় বাংলাদেশও। এ অবস্থায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে আমরা ছায়ানটের ক্লাসসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখি। রিহার্সালও বন্ধ করে দিই। বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, চারদিকে মানুষ মরছে। এর মধ্যে উৎসব করলে সেটা বিলাসিতার হয়ে যাবে। অন্যায় হবে। আমরা সেটি তাই করতে চাইছি না। তাহলে কী করার চিন্তা? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই দুর্যোগের কালে কী করা যায়, সেটাই আজকে আমাদের ভাবতে হবে। সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা পহেলা বৈশাখে ঘরে বসেই বাঙালিত্বের সাধনা করব। আরও কী করা যায় তা নিয়ে ভাবব। প্রতি বছর রমানা বটমূলের অনুষ্ঠানে আপনি সমকাল বিশ্লেষণ করে যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন, সেটি কি এবার থাকবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ভাষণটি লেখা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় নতুন করে লিখতে হচ্ছে। এ সময়ে সংস্কৃতিকর্মীদের কী করা উচিত, কার কী দায়িত্ব ইত্যাদি নতুন ভাষণে তুলে ধরার চেষ্টা হবে। লেখা হয়ে গেলে ভাষণটি আমি পাঠ করব, যা অডিও ভিডিও রেকর্ড করে প্রচার করা হতে পারে। তবে এখনও কোন কিছু চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান তিনি। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে সন্জীদা খাতুন বলেন, আমরা সব সময় মানুষের কথা ভেবেছি। সমাজের ভাল চিন্তা করেছি। জীবন বিচ্ছিন্ন গান বা নাচ করে কাটাইনি। বরং জীবন ঘনিষ্ঠ সংস্কৃতির চর্চা করেছি। একই কারণে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু করার চিন্তা করছি আমরা। শুধু চিন্তা নয়, এরই মাঝে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবের বাজেট থেকে ২ লাখ টাকা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যয় করার জন্য দান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বলেন, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে মঙ্গলবার এই চেক হস্তান্তর করেছি আমরা। একইভাবে বর্ণাঢ্য উদ্যাপন থেকে সরে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। অনুষদের পক্ষ থেকে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দেয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। শিল্পকর্ম নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে যান সবাই। কেউ ক্যানভাসে ছবি বা সরাচিত্র আঁকেন। কেউ মুখোশ তৈরি করেন। বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা অনুষঙ্গ তৈরি করা হয়। কিন্তু এবার সেটি হবে না বলেই জানা যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীরা যে যার মতো চলে গেছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে করোনা পরস্থিতি বদলে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কি ভাবছে চারুকলা অনুষদ? জানতে কথা হয় অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে আমরা বাঙালীর মঙ্গল কামনা করি। অমঙ্গল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই। এবার মানুষের মঙ্গল চিন্তা থেকেই ঘরে থাকতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে আমরা সবাইকে মিলিত হতে বলি, একত্রিত করার চেষ্টা করি। সেটি এবার করা যাবে না। বরং ঘরে বসেই স্পিরিটটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি বলেন, আমরা শিল্পীরা ঘরে বসেই লোক ঐতিহ্য তুলে ধরে ছবি আঁকতে পারি। সরাচিত্র করতে পারি। বিভিন্ন পোস্টার আঁকা যেতে পারে। পরে সেগুলো ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারি। এমন আরও কি করা যায় তা নিয়ে শিল্পীদের ভাবার পরামর্শ দেন নিসার হোসেন। বিকল্প হিসেবে মানবিক সহায়তায় নিয়ে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান তিনি। বলেন, বর্তমানে চারকলা অনুষদের শিক্ষকরা তাদের নিজেদের অর্থে চিকিৎসকদের জন্য পিপিই তৈরির কাজ করছেন। প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার পিপিই তৈরি করা হয়েছে। এগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে প্রদান করা হবে। একই প্রসঙ্গে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতার কারণে উগ্রবাদীরা মৌলবাদীরা বাস্তবতা বুঝে না। আমরা উদার চিন্তার। আমরা মানুষের জন্য যা ভাল তাই করতে চাই। সে চিন্তা থেকেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা আমাদের বক্তব্য বলেই মনে করি। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নববর্ষ উদ্যাপনের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, ঘরে বসেও পহেলা বৈশা উদ্যাপন করা যেতে পারে। কী ভাবে হবে সেটা নিয়ে ভাবতে পারি আমরা। তার চেয়ে বড় কথা, ভেতরে বাঙালিত্বের চর্চা ধরে রাখতে হবে। তবেই বর্ষবরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×