ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তৌহিদুর রহমান তুহিন

বাঙালী বাংলা ভাষা ও জাতীয়তাবোধ

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাঙালী বাংলা ভাষা ও জাতীয়তাবোধ

ভাষা আন্দোলন বাঙালীর মানসপটে এক জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। সৃষ্টি করে এক নতুন অধ্যায় যা বাঙালীর দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে অনবদ্য স্থান দখল করে রেখেছে। ভাষা আন্দোলন ছিল সংস্কৃতি ও নিজ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। ছিল পূর্ব বাংলার ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে স্বতন্ত্র্যতা বজায় রাখা। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ষড়যন্ত্র ছিল বাংলা ভাষার পরিবর্তন। চেয়েছিল অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাঙ্গন তৈরি করতে। এই উদ্যোগের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। বাংলা ভাষার আদি শব্দ বাদ দিয়ে সেখানে উর্দু ও আরবী শব্দের প্রবেশ-অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করে। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে বাংলা ভাষার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। একটা বিষয় না বললেই নয় তা হলো- পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায়। যুগের পর যুগ ধরে এই বাংলায় মানুষ ধর্মবর্ণসহ নির্বিশেষে বসবাস করে আসছে। ভারতবর্ষের প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আলাদা। এই আঞ্চলিক সাক্ষতন্ত্র সত্ত্বেও বাঙালী সংস্কৃতি বলে যা পরিচিত তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভাষানির্ভর। এই ভাষার ওপর ভিত্তি করেই সবাই এক সুতোয় গাঁথা। বাংলা ভাষা এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির সম্মান রক্ষার্থেই এই আন্দোলন সংঘটিত হয়। তবে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক তাৎপর্য সব কিছুকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানকে ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা প্রদান করে। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি মিললেও কার্যত পূর্ব বাংলার জনগণ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। বাংলার মানুষের ওপর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতে লাগল। মাত্র ৮% উর্দুভাষীর জনগণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার জন্য চিন্তা করছেন যেখানে ৫৬%-এর বেশি রয়েছে বাংলাভাষী। বাংলার মানুষ এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে একটি প্রকাশনা। এতে দাবি করা হয়Ñ পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা। যা তৎকালীন আন্দোলনকারীদের আরও সাহস যুগিয়েছে। ভাষার প্রশ্নে সবাইকে এককাতারে দাঁড় করিয়েছে। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসল ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। প্রস্তাবটির সরাসরি বিরোধিতা করেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে। তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে অনৈসলামিক সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাস হয়ে যায়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান এবং ভারত নামে দুটি আলদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও বাঙালী ছিল একটি সম্পূর্ণ আলাদা জাতিসত্তা। পূর্ব বাংলা হয়ে ওঠে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মেলবন্ধন। সেদিন ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে সকল স্তরের মানুষ ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রতিরোধ থেকেই বঙ্গবন্ধুৃ শেখ মুজিবুর রহামানকে পুলিশ গ্রেফতার করে। আন্দোলনের মাত্রা আরও তীব্র হতে থাকে। ২১ মার্চ, ১৯৪৮। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ বাঙালী জাতীয়তাবাদে তীব্র আঘাত করে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোন ভাষা নয়। ২৪ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে পুনরায় একই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন টৎফঁ ধহফ ড়হষু টৎফঁ ঝযধষষ নব ঃযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ. উপস্থিত ছাত্ররা তখন না, না করে প্রতিবাদ করতে থাকে। ১৯৫১ সালের দিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দাবি ক্রমাগত জোড়ালো হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেদিন সকাল থেকেই দলে দলে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকে। উদ্দেশ্য, বাংলা ভাষা দাবিতে সোচ্চার হওয়া ও মাতৃভাষার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা। চারদিকে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে সভা থেকে মিছিলটি বের হলো। পথিমধ্যে পুলিশের বাধার মুখে পড়লে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। গুলি চালায় পুলিশ- মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ে আব্দুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন। রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে বাংলার পথঘাট, আঘাত করে অস্তিত্বে। এই রক্ত যেন বাংলার সকল মানুষকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলে। সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে সবাই মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করে। যার ফলে চুয়ান্ন সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে, যা ছিল পাকিস্তান সরকারের এক চরম পরাজয়। আর বিশ্বে বাংলাভাষা ও বাঙালী মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে। জানান দিয়ে দেয়, বাঙালী জানে কিভাবে তার অধিকার আদায় করতে হয়। কখনও কারও কাছে মাথা নোয়াবার নয়। যত বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, বাঙালী জাতি সব সময় একতাবদ্ধ হয়ে সকল শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বীরদর্পে লড়বে। বাঙালীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে যে অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে ছিল তা জনসাধারণের মনে বিস্ফোরিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের যে চেতনা মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে দখল করেছিল তা পরবর্তী প্রতিটা আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালী জাতিকে একত্রিত করেছে। সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, রক্ত দিতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করেন। যার দরুন কোন শক্তি বাঙালী জাতিকে বশ করতে পারেনি। বাঙালী জনগোষ্ঠীকে যখন পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তখন পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শোষণের মাত্রা দিন দিন বাড়তেই থাকে। সকল অত্যাচার ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন যাকে বলা হয় বাঙালীর মুক্তির সনদ। যেখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বাংলার মানুষের মনে আশার সঞ্চার হতে থাকে, স্বপ্ন দেখতে থাকে নতুন ভোরের। পাকিস্তান সরকার এতে ভীত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন। এই মামলা যেন বাঙালীর জমে থাকা আগুনে বাতাস দিতে থাকে। চারদিকে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালীর অধিকারবোধ ও স্বাতন্ত্র্য চেতনা জাগিয়ে তোলার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৫২ সালের পরবর্তী সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ভাষা আন্দোলন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। যার প্রভাব এতই সুদূরপ্রসারী ছিল যে সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপিত হয়েছে। যা প্রতিটি মুক্তি সংগ্রাম, আন্দোলনকে বেগবান করেছে। সবাইকে এককাতারে নিয়ে দাঁড়িয়েছে। যা ঐক্য ও বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদ পূর্ব বাংলার মানুষকে স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন দেখায়, উজ্জীবিত করে সাধারণ জনতাকে। তৈরি হয় সাহসী, দেশপ্রেমিক, বীরের জাতি। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হয় নতুন প্রজন্ম। পৃথিবীতে যত দেশ রয়েছে এদের প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা জাতীসত্তা ও নিজস্ব স্বকীয়তা। কিন্তু শুধু বাঙালীরাই ভাষার জন্য রাজপথে নেমেছে, লড়াই করেছে। রক্তদানের মাধ্যমে রচিত করেছে একুশে ফেব্রুয়ারির অমর ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালী হৃদয়ে পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশ পায়। বলা যায়, বাঙালীর সকল প্রকার অধিকার আদায়ের সূচনা ছিল ভাষা আন্দোলন। প্রথমত, ভাষা আনদোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ দাবি আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দাবি পূরণের স্বাদ গ্রহণ করে। যা প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে পরবর্তী দাবি আদায়ে এবং উপলব্ধি করায় যে-আন্দোলন ব্যতীত কখনও অধিকার আদায় সম্ভব নয়। এই আন্দোলন মানুষের মনোবলে সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঞ্চার করে যা বাঙালীর মনে জাতিয়তাবোধ চেতনার উন্মেষ ঘটায়। পরবর্তীতে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাষা আন্দোলনের মনোবল ও শক্তির রসদ যুগিয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মানচিত্রে এক অনন্য আসন গড়ে তুলেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের নাম উচ্চৈঃস্বরে ব্যবহার হচ্ছে। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয়তাবাদের চেতনায় জাগ্রত হতে হবে। বাঙালী অতীতে কখনও হারেনি, ভবিষ্যতেও হারবে না। [email protected]
×