ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মো. জোবায়ের আলী জুয়েল

দেবী চৌধুরানী ভবানী পাঠক ও নুরুল দীনের উৎসের সন্ধানে

প্রকাশিত: ১২:৪১, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

দেবী চৌধুরানী ভবানী পাঠক ও নুরুল দীনের উৎসের সন্ধানে

পলাশী পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর দিনাজপুর রংপুর জেলা বহুদিন ধরে অশান্তি ও উপদ্রবের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল, ইতিহাস প্রসিদ্ধ অত্যাচারী ইজারাদার ‘দেবী সিংহের’ অত্যাচারের ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে সমগ্র রংপুর ও দিনাজপুর প্রজা সাধারণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচ- বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ইংরেজ বেনীয়া ‘গুড লাট সাহেব’ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র উত্তরবঙ্গে ‘ফকীর মজনুশাহ’ ‘ভবানী পাঠক’ দেবী চৌধুরানী ও নুরুল দীন দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সারা বাংলায় বারুদের মতই প্রচ- দাবানল জ্বলে উঠে। তাদের প্রজা সাধারণের সমগ্র যৌথ বাহিনীর লোকসংখ্যা ছিল ৬০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে সম্ভবত ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় তাদের বিদ্রোহ হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে ‘ঢাকার’ এবং শেষের দিকে ‘রাজশাহীর রামপুরা বোয়ালিয়া ইংরেজ কুঠিদ্বয় ‘সন্ন্যাসী ও ফকির’ বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করে দখল করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলার ফকির সন্ন্যাসীরা দুটি এলাকার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছিলেন প্রথমটি হলো ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রংপুরের শ্যামগঞ্জে ‘ক্যাপ্টেন টমাসের বাহিনীর’ বিরুদ্ধে এবং দ্বিতীয়টি ও ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ রংপুরের বড়রাজ পরগনায় ‘ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডের’ সৈন্যদের মোকাবেলায়। তৎকালীন ইংরেজ বেনীয়া মহল থেকে যেসব হামলা এসেছে তাতে মুসলমান ফকির, দরবেশ এবং বাঙালী সন্ন্যাসীরাও দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইংরেজরা তাদের চিঠিপত্রে এসব দেশ প্রেমিক মুক্তি যোদ্ধাদেরকে ‘ফকির সন্ন্যাসী’ নামে ‘লুটতরাজকারী’ বলেছেন। কিন্তু যেহেতু জাতীয় ইতিহাসে বিরাট অধ্যায় জুড়ে আছে এসব যুদ্ধ বিগ্রহ তাই পরবর্তীকালে কেউ চেয়েছেন তাকে জাতীয়তাবাদী রূপ দিতে, কেউ চেয়েছেন শ্রেণী সংগ্রাম বলে চিত্রিত করতে। ইংরেজদের সম্মুখ যুদ্ধে যারা সে সময় বাংলার দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তারা হলেন মজনুশাহ, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ও নুরুল দীন। বাংলার ইতিহাসে এরা সবাই বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। সমসাময়িক ইংরেজ কালেক্টরেট ‘গুডলাট সাহেব’ ও ‘ল্যাফটেন্যান্ট ব্রেনান’ এদের কে ডাকাত ও দস্যুরাণী বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তাদের মূলত উদ্দেশ্যই ছিল দস্যুবৃত্তি ও লুণ্ঠন করা বলে যে সময়ে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বাংলার ইতিহাসে এদের দস্যু ডাকাত বলা যায় না, তারা দেশকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীন করার জন্য খন্ড খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এই বাংলার বুকে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করে ছিলেন। ব্রেনান সাহেবের মতে ‘দেবী চৌধুরাণী’ একজন বিখ্যাত মহিলা জমিদার ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিরাট বরকন্দাজ বাহিনী লালন করতেন। তাঁর অনুসারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজারের মতো। ‘দেবী চৌধুরাণী’ ব্রিটিশের পোষ্য বঙ্কিম বাবুর কল্পিত ডাকাত সর্দারনী ছিলেন না। তিনি ছিলেন কুড়িগ্রাম রংপুর রেল-পথে ‘মীরবাগ স্টেশনের’ কাছে ‘কুরশা গ্রামের’ মেয়ে এবং পীরগাছা মন্থনার প্রজা বৎসল জমিদার ‘জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণী’। ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরাণী দু’জনেই ছিলেন তৎকালীন বাংলার মাটি ও মানুষের আপন জন ও বিখ্যাত জমিদার। বিদেশী ইংরেজ এবং তাদের এদেশী দোসর পশ্চিমা ‘কুলীন’ রাজা, মহারাজা, জমিদারদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল বিরোধিতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের। সে সময়ে বাংলার যে ১৫টি বড় জমিদারী, রাজা, মহারাজা ইংরেজদের নিত্য সহযোগী ছিলেন বাংলার বিদ্রোহীরা কেবল তাদের কাচারী লুট করেছেন, অত্যাচারী কর্মচারী ধরে নিয়ে টাকা আদায় করেছেন। সেগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে দিনাজপুর জমিদারী, মোমেন শাহী জমিদারী, ঘোড়াঘাট জমিদারী, নাটোর জমিদারী, দিঘাপাতিয়া জমিদারী ও মুক্তা গাছা জমিদারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সারাদেশে এরূপ ছিন্নমূল, নিপীড়িত জনসাধারণ জমিদার ও বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংবদ্ধ হয়। ধর্মপ্রাণ সন্ন্যাসীরাও তাদের এ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। রংপুরের দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের সঙ্গে ইংরেজ সেনাপতি ‘লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের’ ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ সংঘটিত হয় (গোবিন্দগঞ্জের কাছে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে)। ভবানী পাঠক ও তার দল সম্মুখযুদ্ধে ক্যাপ্টেন ব্রেনানের হাতে সদল বলে নিহত হন। পাঠকের প্রধান সহকারী একজন পাঠান ও এই সময়ে নিহত হন। দেবী চৌধুরাণীর নামানুসারে রংপুরের একটি রেলস্টেশনের নাম চৌধুরাণী আজও তার স্মৃতি বহন করে চলেছে। ভবানী পাঠক উত্তর প্রদেশের বাজপুর বা ভোজপুর বিহারের বাসিন্দা ছিলেন এ ভোজপুর বিহার প্রদেশের আরা জেলায় অবস্থিত ছিল। তাঁর নামানুসারে দিনাজপুরের ভবানীপুর নামক একটি রেলস্টেশন রয়েছে। ভবানী পাঠক দেবী চৌধুরাণীর একজন বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে অনেক খ-যুদ্ধে তিনি ‘দেবী চৌধুরাণীর’ সঙ্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে তৎকালীন যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তারা বিরাট বজরায় বাংলার গহীন অরন্যে নদীপথে সর্বদাই লোক চক্ষুর অন্তরালে চলাচল করতেন। তাদের বিদ্রোহের কেন্দ্রভূমি ছিল মন্থনা, বামন ডাঙ্গা, টেপা, ফতেপুর ও কাজীহাটা। মজনুশাহের সঙ্গেও ভবানী পাঠকের বিশেষ সৌহার্দ ছিল। নূরল দীন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি মূলত উত্তরাধিকারী সূত্রে কোন নবাব ছিলেন না। দিনাজপুরের অত্যাচারী দেওয়ান (অর্থমন্ত্রী) দেবী সিংহের বিরুদ্ধে তিনি প্রজাদের নিয়ে শক্ত ঘাটি গড়ে তোলেন। রাজস্থানের মাড়োয়ারী তথা পানি পথের অধিবাসী বণিকদের অগ্রদূত ছিলেন রাজ জমিদারীর কুখ্যাত দেওয়ান এই দেবী সিংহ। দেবী সিংহ অত্যাচারী শাসক, কুখ্যাত ব্যবসায়িক, মুনাফাখোর, লুণ্ঠন, অপহরণ ও নারী ধর্ষণ, ব্যাভিচারের যে কুকীর্তি রেখে গেছেন তা দিনাজপুরের ইতিহাসের পাতায় ঘৃণিত ও অত্যাচারীর এক দলিল হয়ে আজো মানুষের মনে ধিক্কার জানাচ্ছে শত শত বার। শহরের গুড়গোলা মহল্লায় তার রাজবাড়ী তুল্য প্রাসাদ ও বিরাটকায় আড়ত ছিল। বর্তমানে বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই। দিনাজপুর শহরে সেই কুখ্যাত দেবী সিংহের নিজের কিংবা আত্মীয় জাত কোন বংশধর আজো আছে কি না তা জানা যায় না। তবে অতীতে ছিল একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। দেবী সিংহের দিনাজপুরে এক ভাই ছিলেন নাম তাঁর বাহাদুর সিংহ। অত্যাচারী দেবী সিংহ দুটি বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তার কোন ঔরজজাত সন্তান ছিল না। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বৃহত্তর রংপুরের কাজীহাটা, কাকীনা, টেপা ও ফতেপুর চাকলার প্রজারা নুরুল দীনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সম্ভবত ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ইংরেজ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট ম্যাক ডোনাল্ড সাহেবের হাতে পাটগ্রামের সম্মুখযুদ্ধে নুরল দীন গুরুত্বর আহত হন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। দেবী চৌধুরাণী সম্পর্কে ব্রেনান কৌতূহল প্রকাশ করেছেন মাত্র। কারণ দেবী চৌধুরাণীর কোন সন্ধান তিনি পান নাই মনে হয়। তবে তার নৌকা থেকে ডাকাতি করা ও বিরাট বরকন্দাজ বাহিনী পোষা ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি যতদূর সংবাদ পেয়েছিলেন তা রংপুরের কালেক্টর সাহেব কে জানিয়েছিলেন। কালেক্টর সাহেব তার জবাবে ১২ জুলাই ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে ভবানী পাঠকের ধৃত অনুচরগণকে ফৌজদারী আদালতে বিচারের জন্যে পাঠাবার কথা আছে, কিন্তু দেবী চৌধুরাণী সম্পর্কে কালেক্টর সাহেব আপাতত কোন নিদের্শ দিতে অপারগ হন। তিনি বলেন- “I can not at present live you any solders with respect to the female decoct mentioned in your letter. If on examination of Bengal (1) Papers which you have dent it shall appear that there are sufficient grounds for après handing her any if one shall be found within the limits of my jurisdiction. I shall here arrest send you such or dears as my jurisdiction. I shall here after send you such orders as may be necessary”. উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দেবী চৌধুরাণী সম্পর্কে এর বেশী কোন সংবাদ সরকারী বিবরণীতে পাওয়া যায় না। ভবানী পাঠক সম্পর্কেও নয়। আজ আমরা স্বাধীনতার বিজয়ের মাসে (১৬ ডিসেম্বর) দেবী চৌধুরাণী নুরুল দীন ও ভবানী পাঠকদের মতো বিপ্লবী ও দেশ প্রেমিকদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য আজ আমরা গর্ববোধ করি।
×