ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্ত আলোচনায় বক্তাদের অভিমত

ন্যায়বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয় বরং আইনের আনুগত্য

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

ন্যায়বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয় বরং আইনের আনুগত্য

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচারের রায় পক্ষে এলে বিচার বিভাগ স্বাধীন, আর বিপক্ষে গেলেই পরাধীন- এটা সঠিক নয়। বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষায় সকলের সচেতনতা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সুপ্রীমকোর্টের তত্ত্বাবধায়নে একটি স্বাধীন সেক্রেটারিয়েট থাকা খুবই জরুরী। আশা করা যাচ্ছে নিকটতম সময়ে তা বাস্তবে পাওয়া যাবে। ন্যায়বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয়, বরং আইনের আনুগত্য। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা করা প্রয়োজন। ‘নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের এক যুগপূর্তি’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ আলোচনাসভায় সংগঠনের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের শীপা হাফিজা, পরিবেশ আইনজীবী সমিতির বেলা নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এছাড়াও দেশের বিশিষ্ট আইন ও সংবিধান ব্যক্তিত্ব, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক ও নাগরিক প্রতিনিধিরা মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবেন। সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন বলেন, ন্যায়বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয় বরং আইনের আনুগত্য। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের চরিত্রে ও অনুভূতিতে স্বাধীনতার বোধ থাকা প্রয়োজন, তাহলেই সত্যিকারের স্বাধীনতা আসবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহসভাপতি এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, বিচারক নিয়োগের স্বচ্ছতায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিচারের রায় পক্ষে এলে বিচার বিভাগ স্বাধীন, আর বিপক্ষে গেলে পরাধীন- এটা সঠিক নয়। বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষায় সবার সচেতনতা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সুপ্রীমকোর্টের তত্ত্বাবধানে একটি স্বাধীন সচিবালয় থাকা খুবই জরুরী এবং আশা করা যাচ্ছে নিকটতম সময়ে তা বাস্তবে পাওয়া যাবে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাসন বিভাগে সম্পৃক্ত করা উচিত নয়। বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির মতামত প্রাধান্য পেলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব হয়। হয়তো বিচার বিভাগ হতে আমরা যতটা চাই ততটা পাই নাই কিন্তু স্বাধীনতার পর হতে বিচার বিভাগের অর্জন কম না। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমাদের বিচার বিভাগ বরাবরই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সবসময়ই সব বিরোধী দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমাদের বিচারক নিয়োগের কোন আইন নেই, নীতিমালাও নেই। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, নিম্ন বা উচ্চ আদালতে ওই ব্যক্তির অবশ্যই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, মেধাসম্পন্ন, সৎ ও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হতে হবে। কিন্তু সবসময়ই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে ক্ষমতাসীন দলের আস্থাভাজন ও দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এই যদি হয় বিচারক নিয়োগের অবস্থা, তাহলে সঠিক বিচার আসবে কি করে? সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যে আমরা যে প্রত্যাশায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে স্বাক্ষর করেছিলাম তা হয়তো অনেকটাই কার্যকর হয়েছে কিন্তু বিচারবিভাগ আর্থিকভাবে স্বাধীন না হলে এ পৃথকীকরণ অনেকটাই মূল্যহীন। মূল প্রবন্ধে মিজানুর রহমান খান নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলেন, বিচারবিভাগ পৃথকীকরণে আমাদের পলায়নপরতার অবসান ঘটুক। মাসদার হোসেন মামলার অর্জনকে পাথেয় করেই অবশ্য আমাদের পথ চলতে হবে। কিন্তু অধঃস্তন আদালতের পুরো একটি চ্যাপ্টার সাংবিধানিকভাব কোমায় আছে কিনা, সেটা একটা বড় জিজ্ঞাসা। এমনও হতে পারে, হয়তো অলক্ষ্যেই এভাবে পড়ে আছে। কিন্তু এভাবে থাকা তো সমীচীন নয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা একটা গ্লোবাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোন কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের উদ্দেশ্যই থাকে তার বিরুদ্ধে যেন কোন রায় না আসে, যদিও বিচারের ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সদাচার জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার। হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সভাপতির বক্তব্যে বলেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের এক যুগ পূর্তি ও মাসদার হোসেন মামলার ২০ বছর পূর্তিতে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখছি বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পুরোপুরি কার্যকরের স্বার্থে। উন্নয়নের জন্য বেশি নিবেদিত- এতটা প্রয়োজন আছে কি না তা প্রশ্নের দাবি রাখে। আমরা যেন উন্নয়নের শরণার্থী হয়ে না যাই সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। আমরা হতাশ নই বরং আশাবাদী, সামনের সময়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনতার সুফল যেন সমাজের সকলে সমানভাবে ভোগ করতে পারবে। আমরা সে লক্ষ্যেই আমাদের কার্যক্রম নিয়ে জেগে আছি। সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠান সঞ্চালক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এ আয়োজনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া।
×