ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ এম এ হাসান

বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

বুদ্ধিজীবী হত্যার নেপথ্যে

পাঁচ-পাঁচটি দিন ও ছয় রাতব্যাপী সুতীব্র আখাউড়া যুদ্ধে বিজয়ের স্বাক্ষর রেখে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক তরুণ অফিসার হিসেবে যখন ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীর কাছে পৌঁছলাম, তখন ১৩ ডিসেম্বর, ঘুমভাঙা প্রভাত নিশিভাঙা গান গাইছে। হেমন্তের হলুদে ছাওয়া শিশিরসিক্ত ধানক্ষেত, নিস্তব্ধ নদী দেখে বুঝবার উপায় নেই যে, কি ভয়াবহ যুদ্ধ চলেছে দেশটাজুড়ে! স্মৃতিতে নিরবচ্ছিন্ন গোলাগুলির শব্দের রেশ, বাঙ্কারে বাঙ্কারে ফেলে আসা মৃত সৈনিক ও সহযোদ্ধাদের ক্ষতবিক্ষত দেহ চেপে বসে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো অবরুদ্ধ ঢাকার ভেতরের মানুষগুলোর জীবন নিয়ে শঙ্কা। শঙ্কা ছিল দুটি দলকে নিয়ে- এর একটি জেনেবুঝে বাংলাদেশের সীমান্তে ও ভেতরে যুদ্ধ করতে করতে যারা প্রাণ দিচ্ছিল তাঁদের নিয়ে; অপরটি ছিল অবরুদ্ধ দেশে ব্যক্তিগত কারণে ও নানা পরিপ্রেক্ষিতে যারা আটকে ছিলেন তাদের নিয়ে। এই অবরুদ্ধ নগরীতে ছিলেন আমার মা, দুটি বোন ও বাবা। যুদ্ধে ছিলাম আমি, আমার ভাই শহীদ লে. সেলিম এবং কয়েক হাজার সহযোদ্ধা। ওই সহযোদ্ধাদের মধ্যে যারা একেবারে অক্ষরহীন ছিল বা একেবারে গ্রামের কৃষাণ ছিল, তাদের প্রাণের মূল্য শহরে আটকে থাকা বিদ্বজ্জন ও বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে কিছু কম ছিল না। উপরন্ত তাদের কেউ কেউ পুরো নয় মাস যুদ্ধ করতে করতে অর্জনের পাল্লা অনেক ভারি করে রেখেছিলেন। আর ভেতরে যারা সাধারণ মানুষ ছিলেন তারা আমাদের স্বজন হওয়ার কারণে বা দেশের জন্য নিরন্তর ত্যাগের কারণে তাদের প্রাণের মূল্য কম ছিল না। তাদের মধ্যে ধীরেন দত্ত, রণদাপ্রসাদ ও জিসি দেবের মতো, যারা নানা কর্মযজ্ঞের মধ্যে বাঙালীর পরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছিলেন অথবা শিক্ষা সংস্কৃতি, সেবায় অনন্য হয়ে দেশের জন্য অমূল্য সম্পদ হয়ে টিকেছিলেন। তাঁদের জীবনের কথা ভেবে শহরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। আর এই ব্যাকুলতার মাঝে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর রাতে আমার কমান্ডিং অফিসার জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর নির্দেশে এক প্লাটুন সেনাসদস্য নিয়ে আমি যখন বাড্ডা হয়ে গুলশান আক্রমণ করি তখন কখনও ভাবিনি আমাদের আক্রমণে যে পাকিস্তানী সেনারা পালিয়ে গিয়েছিল, তারা তলে তলে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ধরে অমন করে হত্যা করতে পারে। হয়ত কাপুরুষ বলেই এটা সম্ভব ছিল, যেমন কাপুরুষ ও নপুংসক বলেই পুরুষাকারের একজন মানুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে অবলীলায়। মূলত বুদ্ধিজীবী হত্যাটা শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইটের সময়। প্রগতিশীল আওয়ামী লীগ নেতাসহ যারা দলের মাথা ছিল তারাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলো প্রজ্বলনকারী, জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণকারী তথা দর্শনের দিশারীদের হত্যার পরিকল্পনা করে পাকিস্তান জেনারেল রাও ফরমান আলী ও তার পরামর্শকগণ। বিষয়টি স্পষ্ট হয় ’৭১-এর আগস্ট মাসে, যখন সাংবাদিক পরিচয়ে দুই মার্কিন গোয়েন্দা জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ কয়েকজন আল-বদর প্রধানের সঙ্গে গোপন সাক্ষাতে মিলিত হয়। তারা ছিল মি. কিসিঞ্জারের প্রতিনিধি। তাদের একজনের নাম ছিল মি. ডুইপ। সে ও তার সহযোগী আগস্টের শেষ সপ্তাহে ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে আমেরিকায় ফিরে যায়। তারা কিসিঞ্জারের যে বার্তা নিয়ে এসেছিল তা হলো, ‘বাংলাদেশকে ভিয়েতনামের মতো লাল হতে দেয়া যাবে না কোন ভাবে।’ অনেকের ধারণা, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু বা ওটাই তাদের নষ্ট কাজের চূড়ান্ত প্রকাশ। মূলত বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয় ’৭১-এ ২৫ মার্চ রাতেই, যখন ৩২ পাঞ্জাবের লে. কর্নেল তাজ খুঁজে খুঁজে ২৫ মার্চের শেষ রাতে ড. জিসি দেব ও তার নিকটতম সহযোগী মোহাম্মদ আলীকে হত্যা করে। ওই রাতে নিহত হয় ড. মুনিরুজ্জামান, অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যসহ আরও সাতজন শিক্ষক। ওই নষ্টকর্মের অন্যতম সংঘটক কর্নেল তাজ, ব্রিগেডিয়ার আসলাম, এর কয়েকদিন পরই রাজশাহীতে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা হত্যা করে রণদাপ্রসাদ সাহা ও বাঙালী ভাষার অগ্রণী সেনা ধীরেন দত্তকে। বাংলাদেশে গণহত্যার সবচেয়ে বর্বর ও ঘৃণ্য অধ্যায়টি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পক ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। জামায়াতে ইসলামীর দফতর সম্পাদক মাওলানা এবিএম খালেক মজুমদারকে দেয়া হয়েছিল ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সমন্বয়ের দায়িত্ব। বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি খসড়া পরিকল্পনা করে জামায়াতের আব্বাস আলী খান ও গোলাম আযম। এই পরিকল্পনা যথাযথ অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছিল রাও ফরমান আলীর নিকট। সেটা করেছিল গোলাম আযম নিজেই। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল বদর বাহিনীর সদস্য আলী আহসান মুজাহিদ, নিজামী, কামারুজ্জামান, মাঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান এমরান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ এহসান, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা জলিল। ফরমান আলীর পরিকল্পনা ও এদের কাজের মধ্যে সমন্বয় করছিল পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার বশির ও ক্যাপ্টেন তাহির। ইপিসিএফ, ওয়েস্ট পাকিস্তান রেঞ্জার্স, পুলিশ ও রাজাকারের কিছু সদস্য এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিল। অনেক বিহারীও এদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিল। শান্তি কমিটির যেসব শীর্ষ নেতা এ কাজে তাদের ছায়া হয়ে কাজ করছিল তারা হলোÑ সৈয়দ খাজা খয়ের উদ্দীন, একিউএম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মোহন মিয়া, মাওলানা সাইয়েদ মোহাম্মদ মাসুম, আব্দুল মতিন, গোলাম সরওয়ার, এএসএম সোলায়মান, একে রফিকুল হোসেন, নূরুজ্জামান, আতাউল হক খান, তোহা বিন হাবিব, মেজর আফসার উদ্দীন ও হাকিম ইরতেজাউর রহমান। মুক্তির জন্য বাঙালীর প্রাণপণ লড়াইকে যখন কোনভাবেই আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না, তখনই পাকিস্তান তার শেষ চাল হিসেবে বাংলাদেশকে প্রশাসনিক ও বুদ্ধিভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে নিঃস্ব করে দেয়ার পরিকল্পনা করে। এ কারণে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যার নীলনক্সা প্রণয়ন করে ঘাতককূল। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানীরা এদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ারসহ শিক্ষিত শ্রেণীর বাঙালীকে হত্যার উদ্যোগ নেয়। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল ছিলেন, তাদেরকেই বিশেষ করে টার্গেট করা হয়। শিক্ষকদেরকে জাতির মাথা ও মেরুদ- ভেবেই পাকিবাহিনী তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাঁটি তৈরির পর পাকিবাহিনী পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী সালেহ, গণিত শাস্ত্রের প্রভাষক মুজিবর রহমান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের ড. রফিক এবং বাংলা বিভাগের ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পাকিস্তানী তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন এ তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে পাকিবাহিনীকে সাহায্য করে। সংস্কৃত ভাষার সহকারী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কাজলার পুকুরপাড়ের একটি গর্তে ফেলে রাখা হয়। ২৫ নবেম্বর মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় পাকি আর্মির অনুগত উপাচার্যের স্টেনো তৈয়ব আলী। ৩০ ডিসেম্বর পদ্মারচরের বাবলা বনে পাওয়া যায় তাঁর লাশ। গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানকে ১৫ এপ্রিল ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার আসলাম ও কর্নেল তাজের অতিথি ভবনের ছাদে। পরে আর ফিরে আসেননি তিনি। ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ ‘পূর্বদেশ’-এ প্রকাশিত রিপোর্টে একটি ডায়েরির কথা উল্লেখ করা হয়। সে ডায়েরিটি বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আল-বদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের বলে উল্লেখ করা হয়। এই আশরাফুজ্জামান মিরপুর গোরস্তানে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করে বলে আগেই সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। যে গাড়িতে করে শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয়, তার চালক মফীজ উদ্দীন পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য জানায়। এ ডায়েরিটির দুটো পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক গোলাম মুর্তজার নাম ও ঠিকানার উল্লেখ ছিল। এই বিশজনের মধ্যে ১৪ ডিসেম্বর যে ৮ জন নিখোঁজ হন তাঁরা হলেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), অধ্যাপক রশীদুল হাসান (ইংরেজী), অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), ড. ফয়জুল মহী (ইসলামী শিক্ষা) ও ডাঃ মুর্তজা। বুদ্ধিজীবী হত্যার শেষ অধ্যায়টি শুর হয় স্বাধীনতার মাত্র ক’দিন আগে ১০ ডিসেম্বর থেকে। এতে প্রথম শিকার হয়েছিলেন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর বার্তা সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন। ৫ জানুয়ারি মিরপুর গোরস্তানে মাটির নিচে পাওয়া গেল শ্রী সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক, ড. ফয়জুল মহী, ডাঃ মুর্তজার লাশ। অন্য তিনটে লাশ ছিল ভয়ানকভাবে গলিত ও বিকৃত যা শনাক্ত করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আল-বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাবেক পিটিআই-এর ব্যুরো চিফ ও বিবিসি সংবাদদাতা নিজামুদ্দিন আহমেদ ও চীফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হকের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত বাংলার ভূমি ভিন্ন অর্থে লাল বর্ণে রঞ্জিত হলো- শহীদের রক্ত ধারায়। বুদ্ধিজীবী হত্যা সফল হলো প্রগতীশীল রাজনীতির পতনের মধ্য দিয়ে, মৌলবাদ ও লুটেরা সংস্কৃতির বিকাশের মধ্য দিয়ে। মি. কিসিঞ্জারের কথামত অর্থবিত্তের আলোকে তলাহীন ঝুড়ি না হলেও মনন ও মূল্যবোধের পরিমাপে তলাহীন ঝুড়ির বৃত্ত থেকে মুক্ত হলো না দেশ আজও। লেখক : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ
×