ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুবিধা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে-

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুবিধা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে-

তার নাম হয়ত অনেকেই জানেন না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য ও কূটনীতির জগতে তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। কোন কার্য উপলক্ষে জাতিসংঘের ক্যাম্পাসে তিনি প্রবেশ করলে কয়েক কদম ফেলতে না ফেলতেই কেউ না কেউ তার ফটো তোলার অনুমতি চাইবে, অথবা তার সঙ্গে করমর্দন করবে কিংবা স্রেফ বলবে আরে কেমন আছেন। তিনি সবাইকেই সাদরে শুভেচ্ছা জানান এবং সেটা অনন্যচিত্তেই করেন এবং সেই সঙ্গে তাকে স্বাগত জানানো ডজনকে ডজন নাম মনে করার চেষ্টা করেন যদিও তা করতে গিয়ে তার পরবর্তী এ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারে বিলম্ব ঘটতে পারে। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস আধানম ঘেব্রেইসাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই মহাপরিচালক ইথিওপিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে এক দশক দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীও হয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা যেমন মা ও শিশুর মৃত্যু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব, আপৎকালীন প্রস্তুতি এবং সর্বোপরি বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিসগুলো থেকে বঞ্চিত-এগুলোর ওপর তার রয়েছে সার্বক্ষণিক, মনোসংযোগ। সে কারণেই টেড্রস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ কতিপয় লক্ষ্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। সেগুলো হচ্ছে ২০তম সালের মধ্যে প্রতিটি দেশকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুবিধার ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সাহায্য করা, ধনী থেকে গরিব হোক প্রতিটি দেশকে তাদের জিডিপির বাড়তি ১ শতাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় নিয়োগের আহ্বান জানানো ইত্যাদি। টেড্রস বলেন সব উদ্যোগেরই উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা। কারণ প্রতিটি দেশে শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারলেই বিশ্ব নিরাপদ হতে পারবে। টেড্রস সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যাকে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে মনে করেন। তবে তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর পেছনে এক যৌক্তিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আছে। এটা জনগণকে দারিদ্র্য থেকে দূরে রাখে অর্থনীতিকে করে শক্তিশালী, মহামারী রোধ করে এবং রোগব্যাধির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার থেকে বিশ্বকে নিরাপদ রাখে। বিপন্ন বা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর উন্নততর স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত করে এটা বর্ণগত, আর্থ সামাজিক ও লিঙ্গ বৈষম্য লাঘব করতে পারে। ইথিওপিয়ায় টেড্রসের শৈশব জীবনে তার তিন-চার বছর বয়সের ছোট ভাইটি হামরোগে মারা যায়। ভাইয়ের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি এটা মেনে নিতে পারিনি। আমি এখনও পর্যন্ত মেনে নিতে পারি না। ২৩ বছর বয়সে ইরিত্রিয়ার আসমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োলজিতে ডিগ্রী নিয়ে তিনি ডেনমার্কে চারমাসের জন্য পড়াশোনা করতে গেলে সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগ স্বচক্ষে দেখতে পান। বিশ্বে স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থায় এই বৈষম্য মেনে নিতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। তার চোখে পড়ল এমন এক দ্বৈত ব্যবস্থা যেখানে একদিকে তার ভাইয়ের মতো ছেলেরা জন্মকালীন দুর্ঘটনায় মারা যায় অথচ অন্যান্য দেশে উন্নত স্বাস্থ্য পরিচর্যার বদৌলতে শিশুরা উন্নতি লাভ করে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে লন্ডনে ইনফেকশাস ডিজিজ ইমিউনোলজিতে মাস্টার্স করার সময় যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালে সুইডেনের সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা দেখে তাঁর এই অনুভূতি আরও সুদৃঢ় হয়। তার মনে প্রশ্ন জাগে চিকিৎসার উপায় যখন আমাদের হাতে আছে তখন লোক মারা যাবে কেন। এই অনুভূতিই তাকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। টেড্রস নামটা পরিবারে প্রচলিত নাম নয়। তার গোটা নাম টেড্রস আধানম ঘেব্রেইসাস, যা তার কাছেও একটা বিজাতীয় নাম। কেননা ইথিওপিয়ায় প্রত্যেকে তাদের ঘরোয়া নামে পরিচিত। তার মনে আছে প্রথমবার তিনি যখন বিদেশে গিয়েছিলেন এবং তার নাম স্বাক্ষর করার জন্য লোকে যখন অপেক্ষা করছিল তার নামটা দেখে কেউ একজন হেসে উঠেছিল। সেই হেসে ওঠার মতো নামটাই আজ বিশ্বস্বাস্থ্যের জগতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। ২০০৫ সালে ইথিওপিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং তারপর ২০১২ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে টেড্রস একজন ম্যালেরিয়া রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে তিনি নারীদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বহুল প্রশংসিত হন। এই ব্যবস্থায় গোটা দেশে ৩৮ হাজার সমাজ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা হয়। তাতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে যে ঘাটতি ছিল তা লাঘব হয় এবং প্রসবকালীন মা ও শিশুর মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রে ২০০০ সালের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কমে আসে। তারপরও ইথিওপিয়ায় তার সময়টা সংঘাতমুক্ত ছিল না। তাঁর সরকারের আমলে দেশে মানবাধিকারের পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। ২০১৭ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক হওয়ার জন্য প্রচার চালাতে গেলে তার বিরোধীরা নিজ দেশে কলেরার প্রাদুর্ভাব ধামাচাপা দেয়ার জন্য তাকে অভিযুক্ত করে। তখনও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন এবং আজও করে চলেছেন। টেড্রস বলেন, তারা জানত নিজেদের প্রচারকাজ চালাতে গিয়ে তারা হালে পানি পাচ্ছে না। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা তাকে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালায়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে টেড্রস বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু’র মহাপরিচালক হন। সংস্থার ৬৯ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম আফ্রিকান প্রধান। পশ্চিম আফ্রিকার ভয়াবহ প্রাণঘাতী রোগ এবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটার অল্পদিন পর তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অনেক সমালোচকের বক্তব্য হলো এবোলার শুরু থেকে এই সংক্রমণ দমনের কাজটা বহু আগেও ভালভাবে করতে পারলে প্রাণহানি সথাসম্ভব কমিয়ে আনা যেতে পারত। দু’বছরে দায়িত্ব পালনকালে টেড্রসকে খুব সহজ পথ পাড়ি দিতে হয়নি। এবোলা আবার ফিরে এসেছে। এবার কঙ্গোতে। বিভিন্ন টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ সংশয় বাড়ছে এবং সেটা প্রধানত পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে। হামের মতো প্রতিরোধযোগ্য রোগব্যাধির নতুন করে প্রাদুর্ভাব ঘটছে। জলবায়ুর পরিবর্তন প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। আর গত কয়েক দশকে পরিস্থিতির আমূল উন্নতি ঘটা সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্প্রদায়কে প্রসবকালীন নারী ও কচি শিশুদের মতো বিপন্ন বা নাজুক গ্রুপগুলোকে রক্ষা করার জন্য এখনও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। হু নিজের জনস্বাস্থ্যও বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার পাত্র হয়েছে। এই মহলগুলো হুর সাংগঠনিক অদক্ষতা ও অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে। জিম্বাবুইয়ের স্বৈরাচারী নেতা বরাট মুগাবেকে ২০১৭ সালে হুর শুভেচ্ছাদূত নিয়োগ করে টেড্রস নিজেও সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত টেড্রস শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন। এসব সমালোচনার মুখে টেড্রস অপার্থিবরূপে শান্ত রয়েছেন। তাঁর শক্তি ও উদ্যমকে কাজে নিয়োগ করেছেন। তার সম্ভবত কিছু সময় বিরতি নেয়া উচিত এমন প্রস্তাব গায়ে না মাখানোর ভাব করে উড়িয়ে দিয়েছেন। দুর্লভ, মুক্ত সময়টুকু পেলে তিনি বলেন সেই সময়টা ইথিওপিয়ায় ফিরে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে কাটান কিংবা নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার ওপর লেখা বইপত্র পড়েন। হুর বেশ কিছু হতবুদ্ধিকর প্রকল্পের প্রতি তিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন। সেই প্রকল্পগুলো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্মূল করা থেকে শুরু করে বিশ্বখাদ্য সরবরাহ থেকে ট্রান্সফ্যাট দূর করা। বিশ্বের যেসব স্বস্থ্য সমস্যাকে সমাধানের অসাধ্য বা দুরূহ বলে মনে হয় সেগুলোকে তিনি অন্তরায় হিসেবে নয় বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন। এই চ্যালেঞ্জগুলো টেড্রসের মন থেকে কখনও দূরে সরে যায় না। তিনি গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। সমস্যা দেখতে চান। শহরে বসে সে সমস্যা দেখা যায় বলে মনে করেন তিনি। টেড্রস বলেন, ‘অনেক মানুষই বলে থাকে তারা ইতিবাচক ভাবনার দ্বারা চালিত। কিন্তু যা আমাকে সকালবেলার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় তা হলো সমস্যা, যার মোকাবিলা করতে হবে। ওটাই আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়।’ টেড্রসের পাঁচ সন্তান যাদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। তাদের একজন জনস্বাস্থ্যের কাজে যোগ দিতে চায়। তার সদর দফতর জেনেভায়। কিন্তু টেড্রস বলেন, তিনি ১৯৪টি দেশের অন্তর্গত। সূত্র : টাইম
×