ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ ছাড় না হওয়ায় আমনে কৃষিযন্ত্র সরবরাহ শুরু হয়নি

প্রকাশিত: ১০:২২, ৩ ডিসেম্বর ২০১৯

  অর্থ ছাড় না হওয়ায় আমনে কৃষিযন্ত্র সরবরাহ শুরু হয়নি

ওয়াজেদ হীরা ॥ আমন মৌসুমের প্রায় অর্ধেকের মতো ধান কাটা হয়ে গেলেও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ভর্তুকির অর্থ ছাড় পাওয়া যায়নি। ফলে মাঠ পর্যায়ে ধান কাটা বা মাড়াই যন্ত্র সরবরাহও করা যাচ্ছে না। অর্থ ছাড়ের বিষয়টি নিয়ে কৃষি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একাধিকবার দাফতরিক চিঠি চালাচালি হলেও অর্থ ছাড় অনুমোদন হয়নি। আর এতে আমনে যন্ত্র ব্যবহার করার ইচ্ছা থাকলেও শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও কৃষকদের মধ্যে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যন্ত্র সরবরাহ না করার কারণে কিছুটা হতাশাও সৃষ্টি হয়েছে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, মূল লক্ষ্য আমন নয়, যান্ত্রিকীকরণে বোরোটাই আসল। দিন দিন কৃষকদের মধ্যে আধুনিক যন্ত্র নিয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কৃষিতে লেগেছে যান্ত্রিকীকরণের ছোঁয়া। এতে কৃষকদের সময় ও অর্থ উভয়ই কম লাগছে। কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনায় যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভর্তুকিও দিচ্ছে সরকার, যাতে এর সুফল পায় কৃষক। এছাড়াও ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে অধিক ফসল প্রাপ্তিতে জমিতে যান্ত্রিক শক্তি ব্যবহার বাড়াতে হবে। কৃষি খাতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে কৃষকদের ভর্তুকি দেয়া প্রসঙ্গে এ বছর অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতাতেও এ বিষয়ে কথা বলেন। সে সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, ফসল কর্তন ও তার পরবর্তী কার্যক্রমে যান্ত্রিকীকরণ উৎসাহিত করা হবে এবং এ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষককে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে চলতি আমন মৌসুমের ধান কাটা শুরু হলেও যন্ত্র ব্যবহার শুরু করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। আবার যন্ত্রের ব্যবহার শুরু না করায় কৃষকদের মতো অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন যন্ত্র আমদানি ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও। এ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভর্তুকির অর্থ ছাড়ের অনুমোদন পেতে দাফতরিক চিঠিও চালাচালি হয়েছে। তবে এখনও অনুমোদন হয়নি। দ্রুতই অর্থ পাওয়া যাবে এমনটাই আশা কৃষি মন্ত্রণালয়ের। কৃষি সম্প্রসারণে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আমন মৌসুম শুরুর আগেই গত ১৭ সেপ্টেম্বর কৃষি সচিব বরাবর রাজস্ব বাজেটের আওতায় কৃষি ভর্তুকি খাত থেকে কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব পাঠায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবদুল মুঈদ। এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বোরো ফসল কর্তনের আগেই যন্ত্র নির্বাচন, ভর্তুকির হার, অর্থের পরিমাণসহ নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের চিঠি পাওয়ার পর কৃষিসচিব অর্থসচিব বরাবর এ বিষয়ে চিঠি পাঠান। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নীতিমালা চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। নীতিমালা না থাকায় পরে কৃষি মন্ত্রণালয় খসড়া নীতিমালা সংযুক্ত করে আবার চিঠি পাঠায়। দ্রুতই এ বিষয়ে অর্থ ছাড় অনুমোদন মিলবে আশা করা হচ্ছে। আমনে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, আমনে যেহেতু ঝুঁকি নেই তাই চিন্তাও নেই। আমরা বোরোটা নিয়ে ভাবছি। মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা এই যান্ত্রিকীকরণের জন্য একটা প্রকল্প দিচ্ছি, যা স্থায়ী (পার্মানেন্ট)। প্রতি বছরই দিয়ে যাব। প্রজেক্ট হবে চার হাজার কোটি টাকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য কিছু বরাদ্দ থাকে সেখান থেকে টাকা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। তারা (অর্থ মন্ত্রণালয়) বলছে, একটি নীতি না হলে ‘পলিসি’ ছাড়া কি করে দেয়া যাবে। এ নিয়ে আমাদের পলিসিটা হয়েও গেছে, কেবিনেটে যাবে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় কিছু টাকা দেবে তা দিয়ে শুরু করতে পারব। বোরোতেই করতে পারব ভাল করে। মন্ত্রী যন্ত্র বিষয়ে আরও বলেন, বড় মেশিনের দাম অনেক। মেশিনের দাম ২৫/৩০ লাখ টাকা। ওই টাকার মধ্যে দেবে ১৫-১৬ লাখ টাকা সরকার ভর্তুকি দেবে। আমরা ভেবে দেখেছি তাড়াহুড়ো না করাই ভাল। আর আমনে যেহেতু বৃষ্টি নেই কাটা ধান শুকাতে পারছে তাই টেনশনও কম থাকে, জানান কৃষিমন্ত্রী। এ নিয়ে কৃষিসচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ভর্তুকির জন্য বোরোই লক্ষ্য ছিল আমাদের। আমনে নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় নীতিমালা করতে বলেছে। নীতিমালার খসড়া হয়ে গেছে। ওই খসড়া নীতিমালাসহ প্রস্তাব দিয়েছি। আশার কথা শুনিয়ে সচিব বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দেবে। আশা করছি আমন শেষের দিকে কিছুটা হয়তো করতে পারব। বোরোটাই আমাদের লক্ষ্য। ইতোমধ্যেই রংপুরের ধানকাটা শেষ। বরিশালের আগাম ধান কাটা শেষ হলেও মূল ধান উঠাতে আরও সময় লাগবে। এছাড়াও আমনে শ্রমিক সঙ্কটও থাকে না। বোরো মৌসুমে যন্ত্র থাকলে কৃষকদের খরচ কম হয়। তবে মেশিনের দাম যেহেতু অনেক তাই বোরো আউশ আমন সব ঋতুতেই ব্যবহার করা গেলে মনে হবে মেশিনটার সঠিক ব্যবহার হলো। বড় বড় মেশিন আমদানি হয় বিদেশ থেকে। কিছু উৎপাদনও হয়। আমদানি ও উৎপাদন উভয় পর্যায়ে এ নিয়ে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থ ছাড় পেলে কৃষক পর্যায়ে মেশিন সরবরাহ করতে পারলে বোরো টিকে থাকে এমন অভিমতও রয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তাদের। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬.৮ কোটি। প্রতিবছর ২০ লাখ হারে তা বৃদ্ধি বাড়ছে। অথচ ফসলি জমি প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কমছে। কৃষিবিদদের মতে, দেশের রোপণ ও কর্তন কাজ এখনও কৃষি শ্রমিকের উপর নির্ভর করে হচ্ছে। ভরা মৌসুমে শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি ও অপ্রতুলতার কারণে কৃষক রোপণ ও কর্তনে অসহায় হয়ে পড়ে। একদিকে শ্রমিকের উচ্চ মূল্য আর শ্রমিক সঙ্কট দুই মিলে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এক্ষেত্রে কৃষি কাজকে সচল রাখার স্বার্থে শস্য কর্তন, রোপণ, মাড়াই যন্ত্রের বিকল্প নেই। দেশে শস্য কর্তন পরবর্তী সময়ে অপচয় বর্তমানে ১৪ শতাংশ, যা যন্ত্রের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৪ লাখ পাওয়ার টিলার ব্যবহার হচ্ছে, যা মোট চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যবহার হয় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এই যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ। দেশে দুই হাজারেরও কম কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার রয়েছে। আর ধান বীজ বোনার জন্য রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের প্রয়োজন ২ লাখ। অথচ দেশে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে এক হাজারেরও কম। শুধু ধান কাটার যন্ত্র রিপারের চাহিদা এক লাখ। অথচ দেশে এ যন্ত্র রয়েছে ৫ হাজার। আর ধান বোনার জন্য পিটিও সিডার আছে মাত্র আড়াই হাজার। দেশে এই যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ। কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের দাম ৭ থেকে ২৮ লাখ টাকা। রোপণযন্ত্র ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। বপন ও কর্তন যন্ত্রের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকদের জন্য ক্রয় কষ্টসাধ্য। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিলেও কৃষকরা এ যন্ত্র ক্রয়ে অনাগ্রহীই থাকছে। এ জন্য এ খাতে সরকারের প্রয়োজনীয় ভর্তুকির চিন্তা রয়েছে। আধুনিক কৃষি গড়তে এবং যান্ত্রিকীকরণ করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আওতায় ‘খামার যান্ত্রিকীকরণ মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্প দেশের ২৫ জেলায় যা সংশোধনীর মাধ্যমে পরে ৩৫ জেলায় বাস্তবায়ন হয়। যেখানে কৃষি যন্ত্রপাতির বিপরীতে ২৫ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিয়ে ৩৮ হাজার ৩৩৮ যন্ত্র দেয়া হয়। কৃষকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বেশ সাড়া পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সাফল্যের ধারাবাহিকতা টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬৪ জেলায় প্রকল্প নেয়া হয়। সেখানে ব্যয় ধরা হয় ৩৩৯ কোটি ৪৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ’১৩ থেকে শুরু হয়ে এ বছরের জুনে প্রকল্প শেষ হয়েছে। খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক শেখ মোঃ নাজিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দীর্ঘ সময় কাজ করে এটা বুঝেছি যে মানুষের মধ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আগ্রহ আছে। এতে আমাদের উৎসাহের জায়গা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
×