ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাঁইজীর দর্শনে তোগাওয়া মাসাহিকো

বাংলায় মুগ্ধ জাপানী গবেষক, নোঙর ফেলেছেন লালনে

প্রকাশিত: ১১:১৭, ২৩ অক্টোবর ২০১৯

বাংলায় মুগ্ধ জাপানী গবেষক, নোঙর ফেলেছেন লালনে

মোরসালিন মিজান ॥ জাপানের সঙ্গে দারুণ একটা সম্পর্ক বাংলাদেশের। নানাভাবে এই সম্পর্ক প্রকাশিত হচ্ছে। তবে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে দুই দেশের যে হাত ধরাধরি, সত্যি আলাদা করে বলার মতো। এ জায়গায় অনেকেই খুব নীরবে কাজ করে চলেছেন। তাদেরই একজন তোগাওয়া মাসাহিকো। জাপানী এই অধ্যাপক একেবারে শৈশবেই বাংলা ভাষার প্রেমে পড়েছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সূত্রে বাংলা নামের দেশটির সঙ্গে জানা-শোনা। সম্পর্ক। বহু বছর ধরে এ দেশে আসছেন তিনি। বাংলার বাউল দর্শন তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। নিজের ভেতরেও যে বাউলের বাস! একতারা হাতে নিয়ে ঘর ছাড়া বাউলের মতোই বেড়িয়ে পড়েন তিনি। বাংলাদেশের নানা প্রান্ত চষে বেড়ান। অচিরেই পৌঁছে যান গন্তব্যে। টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের অধ্যাপক নৃ-বিজ্ঞানী নোঙর ফেলেন লালনে। মহান মানবতাবাদী বাউল সাধকের একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে ওঠেন তিনি। শুরু করেন লালন গবেষণা। জাপানী ভাষায় লালনের জীবনীগ্রন্থ রচনা করার অনন্য কৃতিত্ব দেখান তিনি। তার রচিত এ গ্রন্থের বাংলা শিরোনাম ‘আধুনিক যুগের ধর্ম এবং একজন সাধকের দর্শন।’ বাংলাদেশের বাইরে বিদেশী ভাষায় লালনের জীবনীগ্রন্থ এটিই প্রথম বলে জানা যায়। নিজের চর্চায়, জীবন দর্শনে লালকে বাঁচিয়ে রাখা স্কলার এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। বিগত দিনের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খুঁজে বেড়াচ্ছেন মনের মানুষ। ভ্রমণ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে মঙ্গলবার এসেছিলেন বাংলা একাডেমিতে। সেখানেই কথা বলার সুযোগ হয় তার সঙ্গে। কিন্তু যতটা কাজের মানুষ তিনি, ততোটাই কম কথার। অত্যন্ত বিনয়ী অধ্যাপককে ছাত্রদের মতোই লাজুক মনে হয়। এর পরও এগিয়ে চলে আলাপচারিতা। বাংলায় সুন্দর বলে যান তিনি। তা, বাংলার সঙ্গে কবে থেকে এই সম্পর্ক? কী করে সম্ভব হলো? জানতে চাইলে তোগাওয়া মাসাহিকো বলেন, জাপানে অনেক আগে থেকেই লালনের চর্চা হতো। শৈশবে আমি লালনের কথা শুনেছি। আর হাইস্কুলে পড়ার সময় জানা হয় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ পড়তাম। তবে সেটি ছিল ইংরেজী থেকে করা জাপানী অনুবাদ। ফলে একটা অপূর্ণতা থেকেই যেত। এর পরও কাজী নজরুল ইসলামসহ বাংলা সাহিত্যের বড় বড় কবি লেখকদের রচনা পাঠের আগ্রহ তৈরি হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জানার কৌতূহল বোধ করি। কিন্তু বাংলা না শিখলে এটি সেভাবে হবে না। তাই বাংলা শেখা শুরু করলাম। প্রথমে টোকিও ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় কোর্স করেছি। পরে ১৯৯২ সালে পা রাখি ভারতের কলকাতায়। এ সময় বাংলা শেখা আমার জন্য বেশ সহজ হয়ে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছি। বাংলাদেশে প্রথম কবে আসা হয়? এমন প্রশ্নে যথেষ্ট পেছনে ফিরে যেতে হয় তোগাওয়াকে। কিছুটা সময় নিয়ে মনে করার চেষ্টা করেন। তার পর বলেন, কলকাতায় যাওয়ার আগে ১৯৮৯ সালের দিকে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলাম। তার পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই আসি। বছরে একাধিকবার আসা যাওয়া হয়। এর ফলে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বাউল শিল্পী গবেষকদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাই। তিনি বলেন, বাংলার বাউলদের উদার মানবতাবাদী দর্শন আমাকে আলোড়িত করে। আর এ দর্শনের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ‘সাঁইজী।’ হ্যাঁ, অগণিত ভক্তের মতো তিনিও লালনকে ‘সাঁইজী’ বলে সম্বোধন করেন। বলেন, আমি অসংখ্যবার কুষ্টিয়ায় গিয়েছি। সাঁইজীর আঁখড়ায় টানা দুই বছর ছিলাম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাউলরা এখানে আসেন। তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়েছে আমার। এর থেকে যা পাওয়া তা এক কথায় অসামান্য। কী অভিজ্ঞতা হলো? লালনকে জানা শেষ হয়েছে? এমন প্রশ্নে ভারি লজ্জায় পড়ে যান তিনি। মন্তব্য করতে রাজি হন না। অনেক পীড়াপীড়ির পর বলেন, সাঁইজী নিয়ে বলার মতো প-িত ব্যক্তিটি আমি নই। এই চর্চা অনেক কঠিন। মহান সাধকের দর্শন বোঝা আত্মস্থ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। আমি আরও অনেকের মতো সবে শুরু করেছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি। আলাপের এ পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করে ফেলেন তিনি। বলেন, বাংলাদেশের একজন লালন আছে। এই সম্পদ আর কারও নেই। এ কারণেই পৃথিবীর নানা দেশ থেকে স্কলাররা এখানে আসেন। বিশ্বমানব হওয়ার তাগিদ নিয়ে ফিরে যান তারা। তিনি যোগ করেন, ভারতে দেখেছি, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়। সমস্যার শেষ নেই। মানুষে মানুষে বা ধর্মে ধর্মে পার্থক্য জাপানেও করা হয়। কম বেশি চোখে পড়ে। আক্ষেপের সুরেই তিনি বলেন, লালনের মতো কাউকে আমরা সেখানে পাইনি। বাংলাদেশে লালনের চর্চা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লালনের মানবতাবাদী দর্শনে বহু মানুষ এখানে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এটা আশার কথা। আবার ধর্মীয় মৌলবাদীরাও কখনও কখনও সামনে চলে আসে। এটা বেদনার। যেখানে সাঁইজী ঘুমিয়ে আছেন, তাঁর দর্শন আছে যেখানে, সেখানে ধর্মের নামে ভেদাভেদ সৃষ্টির চেষ্টা দুঃখজনক। এর পর কিছুটা সান্ত¡না বাণী শোনান তিনি। বলেন, জীবদ্দশাতেই সাঁইজী আক্রান্ত হয়েছেন। ধর্ম জাত পাতের পার্থক্য ভুলে মানব সমাজ গঠন করার তার যে আহ্বান, পরাজিত হয়নি। হবে না। এ জন্য লালনের দর্শন আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দেন তিনি। লালনের গানও একইভাবে অভিভূত করে জাপানী ভক্তকে। তিনি সুর করে গাইতে পারেন না। তবে মনে মনে গুনগুন করেন: এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।/যে দিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে...।
×