ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন চার রাত জেগে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শোনার মানুষ আছে

প্রকাশিত: ১০:২৪, ১৯ অক্টোবর ২০১৯

 তিন চার রাত জেগে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শোনার মানুষ আছে

গৌতম পান্ডে ॥ শীতের রাত, রাজধানীর ধানমণ্ডি শেখ কামাল আবাহনী মাঠে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের দ্বিতীয় রজনীর শেষ পরিবেশনায় অংশ নেন গোলাম বন্দেগি খান বাঙ্গাস ঘরানার সেতার বাদক পন্ডিত দেবজ্যোতি বোস। পন্ডিত রনু মজুমদারের বাঁশির সঙ্গে যুগলবন্দী বাজিয়েছিলেন তিনি। বাজানোর আগে তিনি বললেন, কেন যে হিন্দুস্তানী বা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বলা হয়, তা বুঝি না। কারণ প্রায় ৬০ শতাংশ সঙ্গীতগুরুরই মূল শিকড় এই বাংলাদেশে। তিনি জানালেন, উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সাধনায় স্বর্গীয় আনন্দ পাওয়া যায়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র জন্মভূমি বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বর্তমান অবস্থা ভাল এ কথা জোর দিয়ে বলা কঠিন। দেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রত্যাশিত ধারায় কেন এগোচ্ছে না, এর জৌলুস কেন হারাতে বসেছে, এ নিয়ে নানা জনের রয়েছে নানা মত। কেউ বলছেন, দেশে ভাল মানসম্মত শিল্পী বা শিক্ষক কিংবা শেখার জায়গা নেই, এ কারণে নতুন শিল্পী তৈরি হচ্ছে না। আবার কেউ বলছেন পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, উপযুক্ত প্লাটফর্ম নেই, প্রচার বা প্রসারের ঘাটতি, সে রকম বোদ্ধা শ্রোতার অভাব ইত্যাদি। প্রচারেই প্রসার কথাটি সর্বজনবিদিত। সেদিক থেকে বলা যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচার-প্রসার আমাদের দেশে তেমন নেই। শুধুমাত্র বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের উৎসব আসলেই মনে হয় প্রাণ ফিরে পেল দেশের মৃতপ্রায় শাস্ত্রীয়সঙ্গীত। উৎসব শেষে আবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এ সঙ্গীতের উত্তাপ। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট্ট দেশে বিটিভিসহ রয়েছে ৩৭টিরও বেশি বেসরকারী টিভি চ্যানেল। এতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচার তেমন নেই। যদিওবা দু’একটি চ্যানেলে কখনও-সখনও প্রচার হয়, কিন্তু তার পরিধি এত সীমিত যে কেউই বুঝতে পারে না কখন কি হয়ে গেল। বোদ্ধা শ্রোতা না হোউক, শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে শ্রোতার ঘাটতি নেই এ কথা বলা যায়। এ প্রসঙ্গে ফরিদপুরের প্রবীণ শিল্পী পন্ডিত অমরেশ রায় চৌধুরী বলেন, আমার বয়স এখন ৯০ বছর। আমার সঙ্গীত জীবনে কখনই দেখিনি বাংলাদেশে শ্রোতা রাত জেগে তিন চার দিন ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনে, যা কয়েক বছর ধরে ঢাকায় বেঙ্গল আইটিসি উৎসবে দেখেছি। সত্যিই আমি মুগ্ধ হয়েছি যে, আমাদের দেশে সারারাত জেগে সঙ্গীত শোনার মানুষ আছে। তবে আরও বেশি বেশি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হওয়া উচিত। বাংলাদেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত চর্চা প্রসঙ্গে প্রথিতযশা শাস্ত্রীয়সঙ্গীতশিল্পী ও শিক্ষক অসিত দে বলেন, যদি কেউ বলেন, আমাদের দেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত চর্চা হচ্ছে না, আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করব। কারণ, এখন নতুনদের অনেকেই শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তারা নিয়মিত চর্চাও করছে। তবে তারপরও বলব, এটা যথেষ্ট নয়। আমাদের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের অগ্রগতিতে মূল বাধা হচ্ছে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে শিল্পীরা পারফর্ম করবে কিভাবে? যদি পারফর্ম করার সুযোগ না থাকে তাহলে তো বাধাগ্রস্ত হবেই। এ শিল্পকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রচার মাধ্যমের। দেশে এতগুলো টিভি চ্যানেল আছে তারা এ সঙ্গীত প্রচারে নিষ্ক্রিয়। তাদের বক্তব্য, শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ক্ষেত্রে স্পন্সর পাওয়া যায় না। প্রিন্ট মিডিয়াও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উদাসীন। এ সঙ্গীত নিয়ে বছরে দু’একটি লেখা তারা প্রকাশ করে। যদি ট্যালেন্টের কথা বলা হয় তাহলে বলব আমাদের দেশে প্রচুর ছেলে-মেয়ে আছে যারা খুবই ট্যালেন্ট। তারা কিছু দূর পর্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করতে থাকে। যখন দেখতে পায় মোটামুটি গাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে কিন্তু কোথাও গাওয়ার সুযোগ নেই তখন আশাহত হয়। যদিও কোথাও গাওয়ার সুযোগ হয় ফ্রি গাইতে হয়। এমন হলে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা নিরুৎসাহিত হবে এটাই হচ্ছে মূল বিষয়। শুধুমাত্র কয়েকটি উৎসব করলেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অগ্রগতি হবে না। যেমন বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের বিষয়ে আমার কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তিও আছে। বাংলাদেশের আর্টিস্টের প্রমোশনের জন্য বেঙ্গল কিছুই করে না। ওই যে একটা স্কুল খুলে রেখেছে সেটাতেই যা করার তাই চেষ্টা হচ্ছে। এদেশের শিল্পীদের প্রতি তাদের ভাবখানা খুবই ইগ্নোরেন্ট। এদেশে যারা গান-বাজনা টিকিয়ে রেখেছে তাদের কোন পাত্তাই দেয় না। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত অনেক বিপত্তির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সাধক আলী এসএম রেজওয়ান বলেন, শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ক্ষেত্রে গত দশ বছরে আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের যা উন্নতি হয়েছে এতে আশার সঞ্চার হয় যে দেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত এগোচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ভাল শেখার জায়গা তেমন নেই। তিনি বলেন, যে কেউ ভাল একটা প্রোডাকশন বানাল কিন্তু সেটা বিক্রির করার জায়গা নেই, কেউ যদি জানতে না পারে তাহলে সেটা কি চলবে? শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই, এটার উদ্যোগ নেবে সরকার, রেডিও, টেলিভিশনসহ বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত যে একটা কালচারকে রিচ করে এটা কোন সরকারই বোঝে না। যে দেশে ক্লাসিক্যাল আর্টের চর্চা না হয়, সে জাতি বা দেশকে সিভিলাইজড বলা যায় না। রেডিওই একমাত্র মাধ্যম যেখানে মানধাতার আমল থেকে সকালে ও রাতে ক্লাসিক্যাল হয়। কিন্তু রেডিও এখন মানুষ খুব কম শোনে। তিনি বলেন, সরকার যখন প্রাইভেট চ্যানেলের লাইসেন্স দেবে তখন শর্ত করে দেয়া উচিত প্রতিদিন দুই ঘণ্টা শাস্ত্রীয়সঙ্গীত হবে, এটা মানুষ শুনুক আর না শুনুক। কারণ ছেলে-মেয়েরা যদি গাওয়ার সুযোগ না পায় তাহলে এর উন্নতি হবে না। এটা এমনই একটা সাবজেক্ট যেটা রেয়াজ ছাড়া হয় না। আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের মেধা, কণ্ঠ, আগ্রহ অনেক কিছুই ভাল কিন্তু এরা শেখা ও গাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের দেশের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ভবিষ্যত কি? এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী অসিত রায় বলেন, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত কোন এক সময়ে রাজা অথবা জমিদারকেন্দ্রিক ছিল। দেশ বিভাগের পর এর পৃষ্ঠপোষকতা উঠে যায়। সে শূন্যতা আর পূরণ হয়নি। অনেকে ভারত থেকে শিখে আসছেন কিন্তু তা আর চলমান থাকে না। নতুনদের ভেতর সম্ভাবনা কিছু দেখা গেলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে তাদের পক্ষে সেগুলো ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত প্রশিক্ষণে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী আসা উচিত, তা হচ্ছে না। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত টিকিয়ে রাখা অনিশ্চিত। এ প্রজন্মের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপও দুষলেন প্রচার মাধ্যমকে। তিনি বলেন, মাঝে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের শিথিলতা এসেছিল কিন্তু এখন অনেকটা সে ঘোর কেটে গেছে। চর্চা হচ্ছে, নতুনরা আগ্রহ প্রকাশ করছে এবং শ্রোতার সংখ্যাও বাড়ছে। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত হচ্ছে আয়েশী সঙ্গীত। এর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে প্রকৃত রস আস্বাদন সম্ভব নয়। যুগের সঙ্গে সঙ্গে সময় স্বল্পতার কারণে এখন চলতে চলতে গান শোনা হয়। এ কারণেই হয়ত নতুনদের কেউ কেউ শাস্ত্রীয়সঙ্গীত পছন্দ করতে চান না। আমাদের দেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পীদের উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী দেয়া হয় না। সে কারণে অনেকটাই এ সঙ্গীতের জৌলুস হারিয়েছে। তবে আমাদের দেশে এ সঙ্গীতকে বাঁচিয়ে রাখতে শিল্পীদের পাশাপাশি প্রচার মাধ্যমেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্লাসিক্যাল গানের প্রতি তেমন আগ্রহী নয়। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে তারা এতে লাভবান তো হয়ই না, রবং লোকসানের ঘানি টানতে হয়। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজার ভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ক্লাসিক্যাল গান শোনার শ্রোতা কোথায়? আমাদের দেশে আধুনিক গানের শ্রোতাই তেমন নেই, সেখানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো শুদ্ধ ও কঠিন গানের শ্রোতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবুও নিজেদের সদিচ্ছা থেকে কোন কোন সময়ে শাস্ত্রীয় গান প্রকাশ করে থাকি। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী সঞ্জীব দে বলেন, সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি ক্লাসিক্যালসঙ্গীত শেখার বিষয়ে অনেক ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ বেড়েছে, এমনকি তারা খুব সিরিয়াসলি করছে। কিন্তু কোন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে দায়িত্ব নিচ্ছে না। আমাদের দেশে প্রায় ৪০টি টিভি চ্যানেল। প্রতিটি চ্যানেল যদি প্রতিদিন আধাঘণ্টার একটা সুযোগ দিত এই প্রজন্মের যারা ভাল গাইছে বা বাজাচ্ছে, তাহলে দেখা যেত কোন না কোন চ্যানেলে একটা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত হচ্ছে। কেউ এই দায়িত্ব নিচ্ছে না। ফলে আজ যারা মনযোগ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিখছে তারা একটা সময় গিয়ে ফ্রাস্টেটেড হয়ে যাচ্ছে। তারা আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নজরুলসঙ্গীত গাইছে। ফলে রাগসঙ্গীতের একটা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সাধক শিল্পী স্বর্ণময় চক্রবর্তী বলেন, শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সৃষ্টি অবিভক্ত ভারতে। এটা শাশ্বত একটা বিষয় কখনও যাবে না, যতই পরিবর্তন আসুক। আমরা রক, পপ এসব বিষয় নিয়ে কিছুটা সন্ত্রস্ত ছিলাম কিন্তু এগুলো আমাদের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতকে মুছে দিতে পারেনি। আমাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে সঙ্গীত প্রতিযোগিতাকে নিয়ে। ওনারা যদি সঠিকভাবে করতেন ভাল হতো, এরসঙ্গে ব্যবসা যুক্ত হওয়ায় এর বিচার ঠিকমতো হয় না। এতকিছুর মধ্যেও অনেক ছেলে-মেয়ে শিখছে এটা আশার সঞ্চার করে। এযুগে এসেও ক্লাসিক্যাল গান শুনছে এটা বড় বিষয়। বিসমিল্লাহ খানের সানাই, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি, জাকির উদ্দিনের তবলা শুনছে এটা কম কিসের। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের পৃষ্ঠপোষকতা নেই। ঢাকায় কিছু কিছু ওস্তাদদের নিয়ে গিয়ে গান শোনা হয়, কিন্তু সেই অর্থে সেটাকে পৃষ্ঠপোষকতা বলা যায় না। শিল্পকলা একাডেমি বছরে একটা অনুষ্ঠান করে কিন্তু সেখানে পরিচিতদের ছাড়া বাইরের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। ঢাকার বাইরের শিল্পীদের তেমন মর্যাদাও দেয়া হয় না। এ প্রজন্মের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি বলেন, আগের চাইতে আমাদের দেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের অবস্থা অনেক ভাল। বেঙ্গল পরম্পরা অনুষ্ঠানগুলো হওয়ায় ইয়াং জেনারেশনের শিল্পীদের চর্চার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সেখানে যারা সুযোগ পাচ্ছে সেই ভাবেই তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের কয়েকজন শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে বেশ সুনাম করেছে। আমাদের ছায়ানটে শুদ্ধ সঙ্গীতের যে ক্লাস হয় সেখানে প্রচুর স্টুডেন্ট ভর্তি হচ্ছে। সেদিক দিয়ে এটা নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। এ প্রজন্মের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী মাহামুদুল হাসান বলেন, সারাদেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সামান্য কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানে শিল্পীরা সে ধরনের কোন সম্মানীও পায় না। যারা কারণে এই লাইনে চর্চা করতে তেমন কেউ আসে না। যারা আসে মূলত সঙ্গীতকে ভালবাসার কারণে আসে। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ইন্ডিয়াতে অনেক সুবিধা আছে। সেখানে সারা বছর অনুষ্ঠান প্রায় লেগেই থাকে। তাদের সেরকম সম্মানীও দেয়া হয়। রেডিও টেলিভিশনেও তাদের দিয়ে অনেক অনুষ্ঠান করানো হয়। আমাদের দেশের স্পেশাল গ্রেডের আর্টিস্টরাও তিনি মাস-ছয় মাস পরে কোন অনুষ্ঠান পায় কি না সন্দেহ আছে। এসব কারণে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের প্রসার তেমন হচ্ছে না। বাস্তবে হয়তো কিছু কিছু ঘাটতি আছে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একদল ভাল শ্রোতা ও প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গাইয়ে-বাজিয়ে তৈরি হয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে নতুনদের এ সঙ্গীতের প্রতি প্রচুর উদ্দীপনাও লক্ষ্য করা গেছে। ছায়ানটের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সম্মেলন, চট্টগ্রামের সদারঙ্গ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন, নারায়ণগঞ্জের লক্ষাপার উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন, যশোরের ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন স্মরণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্মেলন, রাজশাহীতে হিন্দোল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব এবং ঢাকার শুদ্ধ সঙ্গীত প্রসার গোষ্ঠীর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রতিবছর কিছু না কিছু উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আসর বসে কোন না কোন জায়গায়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এ কথা সত্যি যে আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকজন আছেন তারা রিয়েল শাস্ত্রীয়সঙ্গীত করেন। অনেকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে প্রথিতযশা ওস্তাদ বা গুরুর কাছে তালিমও নিয়ে থাকেন। কিন্তু তেমন অনুষ্ঠান বা সিডি প্রকাশের সুযোগ না থাকায় অনেকেরই টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। কেউ কেউ নজরুল, রবীন্দ্র অথবা অন্যান্য গানের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। বাস্তবতার নিরিখে এটা করতে বাধ্য হতে হয় তাদের। প্রশ্ন হলো, শিল্পীর সারা জীবনের শিল্প সাধনার গন্তব্য কি তাহলে টিউশনি? এভাবে চলতে থাকলে দেশের প্রকৃত শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ভবিষ্যত কি তাহলে অনিশ্চিতের দিকে ধাবিত হবে না? বিদগ্ধজনরা বিরক্ত হলেও এ কথা সত্যি যে, এ প্রজন্মের অনেকের কাছে ক্লাসিক্যাল গান মানেই একটি বিরক্তির বিষয়। অনেক গণমাধ্যম রাগসঙ্গীত প্রচার করতে চায় না শ্রোতার রুচি নেই বলে। কিন্তু প্রচার-প্রসার ছাড়া কোন শিল্পকর্মই টিকে থাকা সম্ভব নয়। জনরুচি বাড়ানোর দায়িত্ব শিল্পী ও প্রচারমাধ্যম উভয়ের। চ্যানেলগুলোর উচিত একদিন রক শো দেখালে, আরেকদিন মানসম্মত রাগসঙ্গীতের অনুষ্ঠান দেখানো। বিটিভির মতো রাত ১১টার পর পাঁচ মিনিটের খেয়াল যথেষ্ট নয়। রাগ সঙ্গীতের প্রসারে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ছায়ানট কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ প্রশংসনীয়, তবে তা আরও বিস্তৃত আকারে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া উচিত, তা হলেই উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ’র মতো সাধকের জন্মভূমি বাংলাদেশে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সুবাতাস বইবে আশা করা যায়।
×