ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের আলোকবর্তিকা

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মধুমতি নদীর কোল ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার কোলজুড়ে প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন শেখ হাসিনা। মাত্র চার বছর বয়সে ১৯৫১ সালে দাদা লুৎফর রহমানের কোলে চড়ে প্রথম ঢাকা আসেন পিতাকে দেখতে। সে সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র ঢাকা শহর ছিল মিছিল আর স্লোগানের নগরী। শুনতে শুনতে ছোট্ট হাসুরও সে স্লোগান মনে ধরে যায়। বাড়িতে গিয়ে বাবাকে যখন পেলেন গলা ধরে বলেছিলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেদিনের চার বছরের শিশুর মনে প্রতিবাদের ধারণা জন্ম নিয়েছিল। ৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আজিমপুর গার্লস স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী থাকা অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভে যোগ দেন। ৬৬-৬৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে বদরুনেচ্ছা) ছাত্র-ছাত্রী সংসদে ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ৬৮ সালে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিঞার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ’৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা অবস্থায় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, তখন তিনি রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর বঙ্গমাতার সঙ্গে ধানম-ির একটি বাড়িতে দীর্ঘ নয় মাস গৃহবন্দী ছিলেন। সে সময় প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্ম হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির জীবনে এক কালো অধ্যায় নেমে এলো। ঘাতকরূপী হায়নারা হত্যা করল জাতির পিতাকে। ভাগ্যক্রমে দুই বোন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। হত্যা করা হয় পরিবারের অন্য সকল সদস্যকে। দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। ৮১-৮২ দলীয় সম্মেলনে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। তিনি যেদিন দেশে ফিরে এলেন সেদিন ঢাকায় প্রচ- বৃষ্টি হয়েছিল। প্রকৃতি যেন শোককে শক্তিতে রূপান্তর করার জন্য অশ্রুবর্ষণ করেছিল, কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ উপস্থিত হয়েছিল মুজিব কন্যাকে স্বাগত জানাতে। লাখ জনস্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,‘সব কিছু হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে এসেছি’। সেদিন থেকে তিনি নতুনভাবে পথচলা শুরু করলেন। সেনা বিদ্রোহে জিয়ার মৃত্যু। আরেক সেনাশাসক এরশাদের ক্ষমতা দখল। সামরিক শাসনের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু। এরশাদ তাঁকে তিন বার গৃহবন্দী করলেও দাবিয়ে রাখতে পারেননি। দীর্ঘ নয় বছর সংগ্রাম করে ফিরিয়ে এনেছিলেন গণতন্ত্র। সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ‘লৌহ মানবী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে সকল প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এক হয়ে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে। ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়া, তিনিও স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বৈরতন্ত্রের পথে চলতে শুরু করে। আবার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের পতন ঘটিয়ে ৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশকে প্রথমবারের মতো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার ঐতিহাসিক পানি চুক্তি, পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওয়ান ডে ও টেস্টমর্যাদা পাওয়ার মতো বিরল অর্জনগুলো সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন থমকে গেল। বাংলাদেশে তৈরি হলো জঙ্গীবাদের উর্বর ভূমি, দুর্নীতিতে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন। আবারও এই অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। জনগণের আন্দোলনের মুখে বিএনপি জোট সরকারের পতন, ক্ষমতা নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারা ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে, রাজনীতি থেকে মাইনাস করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার পরিকল্পনা করে। এবারও বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলনের মুখে জনগণের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০৯ সালে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিক্তিক মহজোট সরকার। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয় লাভ, দীর্ঘদিনের সিটমহল সমস্যার সমাধান, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর। কৃষি, খাদ্য, শিক্ষা, বিদ্যুতের ব্যাপক উন্নতি করা। এক সময়ের তলাবিহীন ঝুঁড়ি এখন খাদ্য রফতানিকারক দেশ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দেশী-বিদেশী চক্রান্তে যখন বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল, তখন জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার মতোই বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছিলেন আমরা নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করব। দেশ বিদেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদরা বলেছিল এটা অসম্ভব। তিনি সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। আজ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার পথে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের ফলে সেটা সম্ভব হয়েছে। আজ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়নে শরিক হতে ব্লাঙ্ক চেক দিতে চেয়েছে, যত টাকা লাগে লিখে নাও। এটাই বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্ব। বাংলাদেশকে বাধাগ্রস্ত করতে বার বার শেখ হাসিনাকে আঘাত করা হয়েছে। ঘাতকদের বুলেট বার বার তাঁর পিছে তাড়া করছে। এ পর্যন্ত ২১ বার প্রত্যক্ষভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি জামায়াত সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে নারকীয় হত্যাকা- ঘটানো হয়েছিল। নেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও ঝরে পড়েছিল ২৪টি তাজা প্রাণ। মনে পড়ে, ৩ অক্টোবর গ্রেনেড হামলার পর পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভা, কয়েক লাখ লোকের জনসমাবেশ। চারদিকে জনতার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কি ঘোষণা দিবেন নেত্রী। জনতার ভিড় ঠেলে নেত্রীর গাড়ি যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেকি স্লোগান আর করতালি। তাদের মাঝে প্রিয় নেত্রী হাজির। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কাঁদছে। নেত্রী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতে আমি নতুন জীবন পেয়েছি। যতদিন বেঁচে আছি আমি আপনাদের পাশে থাকব। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও যেন নেতা-কর্মীদের জীবন বাঁচে। আপনাদের জন্য বাবা, মা, ভাইদের মতো আমিও আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। আমার ছোট্ট জীবন এদেশের দুঃখী মানুষের জন্য উৎসর্গ করলাম।’ পিতার কাছ থেকে শিখেছেন রাজনীতির পাঠ। রাজনীতিতে যেমন কঠোর ও আপোসহীন, ব্যক্তি জীবনে ক্ষমাশীল ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। মিয়ানমারের নির্যাতিত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে আজ তিনি রোল মডেল। পেয়েছেন মাদার অফ হিউমিনিটির খেতাব। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। জিডিপি থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বের কাছে বিস্ময়ের নাম বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ অন্য দেশগুলোর কাছে অনুকরণীয়। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার পিতৃপুরুষের জন্মস্থান কেনিয়া সফরকালে বলেছিলেন, কেনিয়ার উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা। আজ সারা বিশ্ব নেতৃত্ব স্বীকার করেছে শেখ হাসিনার উন্নয়নের ম্যাজিক। শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। তিনি যেমন নিষ্ঠাবান ধার্মিক, তেমনই অসাম্প্রদায়িক। তার বিজ্ঞানমনস্ক জীবনসৃষ্টি তাকে করেছে আধুনিক রাষ্ট্রনায়ক। লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য সম্প্রীতি বাংলাদেশ [email protected]
×