ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এখনও পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা, ৩ দিনে নতুন ৮ শতাধিক

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এখনও পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা, ৩ দিনে নতুন ৮ শতাধিক

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এখনও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় কোন ভূমিকায় রাখছে না। বরঞ্চ পালিয়ে আসার জন্য গোটা সীমান্তই যেন তারা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবার রাতসহ গেল তিনদিনের ৮ শতাধিক রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশু নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে উখিয়ার ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়ে। প্রত্যাবাসন চুক্তির পর গত আড়াই মাসে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে খসড়া পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। এদিকে, রাখাইন রাজ্যে ঘটে যাওয়া সেনা অভিযানে বর্বরতম ছোবলে শত শত রোহিঙ্গা প্রাণ হারানোর ঘটনাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করার পর এখন সেদেশের এনএলডি নেত্রী ও পররাষ্ট্র বিষয়কমন্ত্রী আউং সান সুচিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। কয়েকটি দেশ সুচিকে দেয়া পদকও প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এরপরও সুচি সরকার এসব নিয়ে কোন ভ্রƒক্ষেপ করছেন না বলে প্রতীয়মান। সর্বশেষ কানাডা মিয়ানমারের এক জেনারেলের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ বর্বরতম নানা আচরণ চালানোর নেপথ্যের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত হওয়া এ জেনারেলের নাম মেজর জেনারেল মং মং সোয়ে। অপরদিকে, গেল শুক্রবার ঢাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে তা বাস্তবায়ন নিয়েও সন্দেহের ডালপালা বিস্তার করেছে ইতোমধ্যে। প্রথম দফায় ৮ হাজার ৩২ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সব রোহিঙ্গাদের তিন পর্বে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার পক্ষ। অথচ তাদের দেশ থেকে প্রতিনিয়ত যে রোহিঙ্গারা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসছে তা নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর বা পরিবেশ সৃষ্টির কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ইতোমধ্যে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থা। এদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে, তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটির কি হবে। এসবই তো জ্বালিয়ে বা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পে বন্দী জীবনে গিয়ে কি লাভ। সেখানেও অনাহারে মরতে হবে। মূলত এ কারণেই প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের কোন আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না। এতে করে মিয়ানমার পক্ষই লাভের ফসল তাদের ঘরে তুলবে। তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বলবে, রোহিঙ্গাদের তাদের ফিরিয়ে আনতে চায় কিন্তু আসছে না। সে যাই হোক, রোহিঙ্গারা গেল বছরের আগস্ট মাস থেকে যে হারে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা এখন অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক হলেও বন্ধ হচ্ছে না। মূলত মিয়ানমার সরকার তাদেরকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পথ খোলায় রেখেছেন। এ প্রক্রিয়াটি প্রতিবেশী বন্ধু দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আগামীতে কি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা মিয়ানমার সরকার বুঝলেও তারা রোহিঙ্গাদের আপদ বিদায় হিসেবে মনে করছে বলে সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের উখিয়ার ট্রানজিট পয়েন্টে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। নিবন্ধন শেষে এদেরকে উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন আশ্রয় ক্যাম্পে পাঠানো হবে বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে। নতুন করে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গাদের দাবি রাখাইনে এখনও নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে চুক্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ যখন এসব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে তখনও নতুন করে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা ঘটনা বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানানো হয়েছে, শুক্রবার মিয়ানমার পক্ষকে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা প্রত্যাবাসনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে ১১ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছিল। অপরদিকে প্রত্যাবাসনের জন্য আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা করে যাচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আরআরসিএর কর্মকর্তা মোঃ আবুল কালাম জানান এখনও প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। আগের মতো ব্যাপক হারে না হলেও প্রতিদিন ১শ থেকে বেশি সংখ্যক অনুপ্রবেশ ঘটছে। অথচ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ প্রত্যাবাসন চুক্তির সময় নিশ্চিত করেছিল তাদের দেশে বাসিন্দাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু অদ্যাবধি এর কোন প্রতিফলন ঘটেনি। এদিকে, মিয়ানমারের তুমব্রু সীমান্তের ওপারে শূন্য রেখায় অবস্থানকারী সাড়ে ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের সুর কিছুটা নরম হয়েছে। শনিবার দুপুরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি টহল দল তুমব্রু জিরো পয়েন্টে সীমান্তে এসে রোহিঙ্গাদের জানান দিয়েছে তোমরা ইচ্ছা করলে আমাদের (মিয়ানমার) ভূখ-ে চলে আসতে পার। উল্লেখ্য, শুক্রবার ঢাকায় দুদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে তুমব্রু সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থানকারী ৬ সহস্রাধিক রোহিঙ্গার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। মিয়ানমার পক্ষ তাদের ফিরিয়ে নেবে আশ্বস্ত করে গেছে। আন্তর্জাতিক গনমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কানাডা মিয়ানমারের ক্ষমতাবান জেনারেল মং মং সোয়েকে নিপীড়নের অন্যতম হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে তার ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিসটিয়া ফ্রিল্যান্ড গনমাধ্যমকে বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এ বর্বরতার নেপথ্যের নায়ক ওই জেনারেল। কানাডার এই সিদ্ধান্তটি এমন দিনে হয়েছে যেদিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনযজ্ঞের ব্যাপারে একটি স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য চাপ প্রয়োগ করেছে। কানাডার মতে, সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে ৬ লাখ ৮৮ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়েছে। রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকারে স্থানীয়দের ক্ষোভ ॥ উখিয়ার টেকনাফ অঞ্চলে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নে নিযুক্ত অধিকাংশ এনজিও কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয়রা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা স্রোতে বিভিন্ন এনজিও রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। ফলে সেখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
×