ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভিডিও ফুটেজের ছবি দেখে খুনীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে

সিদ্দিক মুন্সী হত্যাকান্ড এখনও রহস্যাবৃত, ক্লু মিলেছে দাবি পুলিশের

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২০ নভেম্বর ২০১৭

সিদ্দিক মুন্সী হত্যাকান্ড এখনও রহস্যাবৃত, ক্লু মিলেছে দাবি পুলিশের

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর বনানীতে মুখোশ পরা সশস্র দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়া এস মুন্সী ওভারসিস নামের জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক সিদ্দিক মুন্সী হত্যাকান্ডের ঘটনা এখনও রহস্যাবৃত। তবে খুনের ‘ক্লু’ খুঁজে পেয়েছে বলে পুলিশের দাবি। বিদেশে লোক পাঠানো নিয়ে অর্থনৈতিক বিরোধের জেরে পেশাদার ভাড়াটে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের খুনের ঘটনা ঘটানোই হত্যাকা-ের মোটিভ। কিন্তু খুনীরা এখনও শনাক্ত হয়নি। ভাড়াটে পেশাদার খুনীরা মুখোশ পরা থাকায় তাদের চিহ্নিত করার বিষয়টি আটকে গেছে। এ কারণেই খুনীদের গ্রেফতারের বিষয়টি ঝুলে আছে। তবে শীঘ্রই খুনী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা যাবে বলে দাবি তদন্ত কর্তৃপক্ষের। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বনানীর চার নম্বর রোডের ১১৩ নম্বর বাসার নিচে থাকা এস মুন্সি ওভারসিসের অফিসের ভবনে থাকা সিসিটিভির ফুটেজে ৪ জনের ছবি দেখা গেলেও পুলিশের ধারণা আরও কয়েকজন এই হত্যাকা-ে জড়িত। গ্রাহক পরিচয়ে অফিসে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ঠা-া মাথায় খুনীরা বেরিয়ে যায় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ সব খুনী পেশাদার এবং কোন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে বলে ধারণা পুলিশের। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যে হত্যাকান্ড- ঘটানো হয়েছে সেই বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই অফিসের প্রবেশ গেটে থাকা সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ জব্দ করেছেন তারা। তার ভিডিওতে জড়িতদের খুঁজতে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর একাধিক টিম। পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, পুলিশ ওই অফিসের ভিডিওফুটেজ ছাড়াও আরও কয়েকটি রাস্তায় থাকা সিসিটিভির ফুটেজ জব্দ করেছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। ওভারসিস অফিস থেকে জব্দ করা ফুটেজে চারজনকে অফিসে প্রবেশের চিত্র স্পষ্ট দেখা গেছে। এদের মধ্যে ৩ জনই ছিল মুখোশধারী। ভিডিওফুটেজে থাকা চিত্র দেখে পুলিশ মনে করছে, খুনীরা পেশাদার। কেননা তাদের মধ্যে কোন অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়নি। হত্যা করে তারা ঠা-া মাথায় বের হয়ে গেছে। খুনীরা কারও পেমেন্ট পেয়েই খুনের মিশনে অংশ নেয় এবং হত্যাকা-ের বিষয়টি যে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক তা হত্যাকা-ের ধরন দেখেই নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। পুলিশের জব্দকৃত ফুটেজে দেখা গেছে, ৪ হত্যাকারীর মধ্যে প্রথমে ২ জন ভেতরে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে একজনের মাথায় ছিল গোল টুপি এবং অন্য জনের মুখের নিচে ছিল মুখোশ লাগানো। তাদের প্রবেশের ১৫ থেকে ১৬ সেকেন্ড পরেই আলাদাভাবে আরও দুজন ভেতরে প্রবেশ করে। এদের একজনের মুখ খোলা অন্যজনের মুখে মুখোশ ছিল। ভেতরে প্রবেশের পরই প্রথমের দুই যুবক ভবন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এ সময় একজন ফোনে কথা বলার ভান করছিল। তারা বের হয়ে যাওয়ার পরই অন্য দুজনও তাদের সঙ্গে বের হয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, খুনের ঘটনাটি প্রথমে ক্লুলেস থাকলেও খুন হওয়া ব্যক্তির অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অর্থনৈতিক বিরোধের জের থেকে যে ঘটেছে সেই ক্লু খুঁজে পাওয়া গেছে। খুনীদের ধরতে জোর চেষ্টা চলছে। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও তদন্ত শুরু করেছে। তবে আসামিদের অবস্থান ও ঠিকানা এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। চার জন এ হত্যাকা-ে অংশ নিয়েছিল এটা প্রমাণিত হয়েছে। তবে আরও কেউ ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কারণ এসব ঘটনায় হত্যাকারীর পাশাপাশি ঘটনাস্থলের আশপাশে আরও কিছু ব্যক্তি থাকে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। বনানীর এস মুন্সি ওভারসিসের মালিক সিদ্দিক মুন্সীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তার সঙ্গে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা তা মাথায় রেখেই তদন্ত করছে পুলিশ। এ ঘটনার আগে সিদ্দিক যে ব্যক্তির নামে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন সে বিষয়টিও আমলে নেয়া হয়েছে। এস মুন্সি রিক্রুটিং এজেন্সির নিচে থাকা নোমান এসোসিয়েটের কর্মচারী আল বিনজ বাজীর পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীতে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার রাত পৌনে আটটার দিকে ২৫ থেকে ৩০ বছরের চার যুবক এসেছিল। তাদের মধ্যে দুজন প্রথমে এবং পরে আলাদাভাবে একজন করে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা বের হওয়ার আগে তিনি অফিসের নিচে থাকলেও কোন গুলির শব্দ পাননি। তিনি বলেন, ‘অফিসে তো অনেকেই আসে তারা যে এমন ঘটনা ঘটাবে, সেটা তো বুঝতে পারিনি।’ একই অফিসের কর্মচারী আলী হোসেন পুলিশকে জানান, তাদের অফিসের নিচে সাধারণ দুটি সিসি ক্যামেরা সক্রিয় থাকলেও ঘটনার দিন শুধুমাত্র এস মুন্সি ওভারসিসের অফিসের নিচের ক্যামেরাটি সক্রিয় ছিল। সেই ভিডিও ফুটেজ পুলিশ জব্দ করে নিয়ে গেছে বলেও জানান তিনি। নিহতের ছোট ভাই আব্দুল লতিফ পুলিশকে বলেছেন, গত রমজানের ঈদের এক ব্যক্তি তার ভাইকে ফোনে হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করেছিলেন। তখন তার ভাই উত্তরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। তিনি আরও জানান, সিদ্দিকের এজেন্সির মাধ্যমে ওই ব্যক্তি কিছু লোককে বিদেশে পাঠানোর জন্য টাকা নিয়ে সেই টাকা মেরে দিয়ে উল্টো এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে সেই ব্যক্তি ফোনে হুমকিও দেন। জবানবন্দীতে আরও বলেন, সিদ্দিক মুন্সী প্রায় এক যুগ থেকে রাজধানীতে থেকে সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর ব্যবসা করে আসছিলেন। সিদ্দিক টাঙ্গাইলের পারকি মধ্যপাড়ার মৃত আনসার আলীর ছেলে এবং তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে সাবরিনা সুলতানা, সাবিহা সিদ্দিক ও ছেলে মেহেদী হাসানকে নিয়ে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ২৪ নম্বরের বাসায় থাকতেন। নিহতের জামাতা আবু হানিফ পুলিশকে বলেছেন, তিনি ওই অফিসের হিসাবরক্ষণের দায়িত্ব পালন করতেন। এর বাইরে তাকে আর কিছুই করতে দিতেন না সিদ্দিক মুন্সী। তবে ঘটনার দিন চার যুবক এসেই ক্যাশ কোথায় রাখা হয়, জানতে চায় এবং পরক্ষণেই এলোপাথাড়ি গুলি করে তারা চলে যায়। তিনি জানান, সিদ্দিকের সঙ্গে কারও কোন বিষয়ে শত্রুতা ছিল না। তবে কী কারণে আর কারাই বা তাকে হত্যা করল পরিবার তা বুঝতে পারছে না। মামলার তদন্ত তদারক করছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মুন্সি ওভারসিসের অফিসের নিচ থেকে ভিডিওফুটেজ জব্দ করা হয়েছে।
×