ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ক্যান্সার থেকে মাইগ্রেন চিকিৎসায় নতুন বিস্ময়

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

ক্যান্সার থেকে মাইগ্রেন চিকিৎসায় নতুন বিস্ময়

ক্যান্সার থেকে শুরু করে মাইগ্রেন পর্যন্ত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর কিছু অগ্রগতি ঘটেছে। অনেক রোগ আগে আগে নির্ণয় করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্যান্সারের মতো রোগ আগাম নির্ণয়ের ফলে সেগুলোর চিকিৎসা করা সহজ হচ্ছে। নিরাময় লাভের সম্ভাবনাও উজ্জ্বলতর হচ্ছে। ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয়ে নতুন পরীক্ষা ফুসফুসের ক্যান্সার আগাম নির্ণয়ে দুটো নতুন পরীক্ষা বেরিয়েছে। প্রথম পরীক্ষায় গালের ভিতরভাগ থেকে নেয়া কোষের নমুনা বিশেষ মাইক্রোস্কোপে দেখা হয়। কোষের বিশেষ ধরনের পরিবর্তন থাকলে মাইক্রোস্কোপে ধরা পড়ে। তা থেকে বোঝা যায় ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে কিনা! পরীক্ষাটির উদ্ভাবক প্রফেসর ভাদিম ব্যাকমান। দ্বিতীয় পরীক্ষাটি সাধারণ প্রশ্বাস পরীক্ষা। প্রশ্বাসের মধ্যে থাকে হাজার হাজার উদ্বায়ু জৈব যৌগিক উপাদান (ভিওসি)। এগুলোর গঠন বিন্যাস ও প্যাটার্নে পার্থক্য থাকে। ফুসফুসের ক্যান্সারের রোগীদের প্রশ্বাসে চার শ্রেণীর ভিওসি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রশ্বাসের ভিওসি নির্ণয়ের প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই বেরিয়েছে। এই পদ্ধতিতে ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক অবস্থার অথবা পুরনো ক্যান্সার আবার ফিরে আসার লক্ষণগুলো ফুটে ওঠার অনেক আগেই তা নির্ণয় করা এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকারের ব্যবস্থা করা সম্ভব। এ অবস্থায় ডাক্তারদের সামনে নানা ধরনের অপশন খোলা থাকবে এবং রোগীকে নিরাময়ের সর্বোত্তম সুযোগ দেয়া সম্ভব হবে। কার্ডিওথোরাসিক সার্জন ড. ইরিন শুমারের গবেষণায় এই কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে। ঘ্রাণ দিয়ে প্রস্টেট ক্যান্সার নির্ণয় একটি ঘ্রাণ পরীক্ষা তাৎক্ষণিক ও নির্ভুলভাবে প্রোস্টেট ক্যান্সার নির্ণয়ের সম্ভাবনা ধারণ করে আছে। কৌশলটি এখন উচ্চতর স্তরের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার পর্যায়ে আছে এবং এ বছরের শেষ নাগাদ তা প্রাপ্তিযোগ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইংল্যান্ডের ইউরোলজিস্ট ডাঃ রাজপ্রসাদ বলেন, পরীক্ষাটি পূর্ণাঙ্গরূপে সফল হলে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটবে। এতে হাজার হাজার জীবন রক্ষাই যে পাবে তাই শুধু নয়, হাজার হাজার পুরুষকে ‘ইনভেসিভ’ পরীক্ষার ঝক্কি ঝামেলাও আর পোহাতে হবে না। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বিশদ বায়োপসিতেও প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা না পড়ার ঝুঁকি থেকে যায়। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি ছিল। আপনি কি হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকিতে একটা সাধারণ রক্ত পরীক্ষাই হয়ত বলে দিতে পারবে যে আগামী ৫ বছরের মধ্যে আপনার হার্ট এ্যাটাক হতে পারে কিনা। এতে করে আপনি ও আপনার চিকিৎসক সেই হার্ট এ্যাটাক রোধ করার জন্য আগে থেকে সম্ভব সবকিছুই করার সুযোগ পাবেন। নতুন এই পরীক্ষায় আপনার শরীরে আগে থেকেই দেহকে রোগাক্রমণ থেকে রক্ষা করার যেসব এন্টিবডি বা প্রতিরক্ষাগুলো রয়েছে সেগুলোর দিকে নজর দেয়া হয়। ইমিউন ব্যবস্থায় উৎপাদিত এই এন্টিবডিগুলোকে বলা হয় আইজিজি। এগুলো দেহকে হার্ট এ্যাটাক থেকে রক্ষা করে। কোলেস্টেরল ও ব্লাড প্রেসার বেশি থাকলেও করে। লন্ডনের গবেষক দল পাঁচ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছেন যাদের আইজিজি এন্টিবডির মাত্রা সবচেয়ে কম তাদের হার্ট এ্যাটাকের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। যাদের আইজিজির মাত্রা যত বেশি তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা তত কম। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা সফল হলে হৃদরোগের ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য বয়স, লিঙ্গ, কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা পরীক্ষা না করে সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় আইজিজি মাত্রা দেখলেই চলবে। মাত্রা কম হলে ডাক্তাররা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা দিতে পারবেন। স্তন ক্যান্সারের বিস্ময়কর চিকিৎসা স্তন ক্যান্সারের রোগীদের হারসেপটিন (ট্রাসটুজুন্যাব) ও টাইভার্ব (লাপাটিনিব) এই দুটো ওষুধ যুক্তভাবে প্রয়োগ করে বিস্ময়কর ফল পাওয়া গেছে। ১১ দিনের চিকিৎসার পর দেখা গেছে ১৭ শতাংশ রোগীর টিউমার একেবারেই ছোট হয়ে গেছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো ১১ শতাংশ মহিলার টিউমার সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে একই চিকিৎসায়। রোগ নির্ণয় ও সার্জারির মাঝপথে পরীক্ষামূলকভাবে ক্যান্সারেরই এই দুটো ওষুধ যুক্তভাবে প্রয়োগের এই ফলটাকে অপ্রত্যাশিত ও নাটকীয় বলছেন চিকিৎসকরা। খুব শীঘ্রই এই যৌথ থেরাপির পরামর্শ দিতে পারেন বিশেষজ্ঞরা। আংশিক অন্ধদের আশার আলো গ্লোকুমা বা অপটিক নার্ভের ক্ষতি কখনও সারে না বলে মনে করা হয়। কিন্তু জার্মানিতে এ ধরনের আংশিক অন্ধ রোগীদের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক এক চিকিৎসা চালিয়ে দেখা গেছে দশ দিন পর তাদের দৃষ্টিশক্তির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। এই দশ দিন তাদের নন-ইনভেসিভ, ট্রান্সঅরবিটাল অলটারনেটিং কারেন্ট স্টিমুলেশন (এসিএস) দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ সোজা কথায় মস্তিষ্কের যে এলাকাটা দৃষ্টিশক্তি ধারণ করে থাকে সেখানে পালাক্রমে বিদ্যুতের প্রবাহ ঘটানো হয়েছিল। অপটিক নার্ভ নষ্ট হবার পর দৃষ্টিশক্তি আংশিক ফিরিয়ে আনার এটা এক নিরাপদ ও কার্যকর উপায়। দৃষ্টিক্ষীণদের জন্য আরও ভাল খবর হচ্ছে, বিশেষ ধরনের অতি ক্ষুদ্র ক্যামেরা তাদের চশমার কাঁচে লাগানো থাকবে যার ফলে তাদের দেখার ও পড়ার ক্ষমতার নাটকীয় উন্নতি ঘটবে। নির্ভুলভাবে আলঝেইমার নির্ণয় আগাম আলঝেইমার রোগ নির্ণয় করতে পারলে রোগীর দারুণ উপকার হয়। একেবারেই আলাদা রকমের দুটি পরীক্ষায় এটা সম্ভব। এমসিআই বা মাইল্ড কগনিটিভ ইমপেয়ারমেন্ট সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিরা আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক অবস্থায় আছে কিনা এবং সেটা ভিমেনশিয়ার কারণ কিনা তা একটা রক্ত পরীক্ষায় জানা যেতে পারে। জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা এই পরীক্ষার উদ্ভাবক। বলাবাহুল্য, সারা বিশ্বে ডিমেনশিয়া না স্মৃতিবিভ্রমে ভোগা লোকের সংখ্যা ৪ কোটি ৭০ লাখ। স্ট্রোক থেকে আশ্চর্যভাবে সেরে ওঠা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হুইলচেয়ারে পড়ে থাকা ৭১ বছরের বৃদ্ধ এখন আবার দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। সেটা সম্ভব হয়েছে এক নতুন চিকিৎসার বদৌলতে যদিও তা এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। এক্ষেত্রে স্টেমসেলকে রোগীদের মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে ইনজেক্ট করা হয়। ১৮ জন স্ট্রোকের রোগীর ওপর এই থেরাপি দিয়ে ৭ জনের বেলায় বিস্ময়কর ফল পাওয়া গেছে। তবে ৬ মাস থেকে ৩ বছরের মধ্যে যাদের স্ট্রোক হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই থেরাপি কাজ দিয়েছে। এতে প্রাপ্তবয়স্কের মস্তিষ্ককে শিশুর মস্তিষ্কে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে মস্তিষ্ক নিজেই নিজেকে পুনর্নির্মাণ করতে পারে। এর আগ পর্যন্ত এটা সম্ভব বলে কখনও ভাবা হয়নি। এই থেরাপির উদ্ভাবক স্ট্যানফোর্ডের গ্যারি স্ট্রেইনবার্গ। মস্তিষ্কে আঘাতজনিত সমস্যা এবং আলঝেইমার, পার্কিনসন প্রভৃতি নিউরোডিজনারেটিভ বা স্নায়ুর অবক্ষয় রোগেও এই থেরাপি কাজ দেবে বলে গবেষকরা আশাবাদী। সবুজ আলোয় মাইগ্রেন সারে যারা মাইগ্রেনে ভুগেন তারা হাল্কা সবুজ আলোর মধ্যে থাকলে ব্যথার উপশম হতে পারে। এটা একটা জ্ঞাত ব্যাপার সে আলো মাইগ্রেন রোগীদের ব্যথার সূত্রপাত করতে বা ব্যথা বাড়াতে পারে। যেমন সাদা, নীল, লাল ও তাম্বর আলো সবই মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ায়। তবে গবেষক দল যে তথ্যটি নতুন আবিষ্কার করেছেন তা হলো সবুজ আলোয় মাইগ্রেনের ব্যথা কমে। অধ্যাপক রামি বারস্টেইন ও তার দল আশা করেন যে, বিশেষভাবে উদ্ভাবিত সানগ্লাস যা সবুজ আলো ছাড়া আর সব আলোক তরঙ্গকে সরিয়ে দেবে তেমন সানগ্লাস পরলে বেশ উপকার পাওয়া যাবে। বারস্টেইন ও তার দল এই সংক্রান্ত পরীক্ষা চালাতে গিয়ে প্রতিটি আলোর রঙের ক্ষেত্রে এসব রোগীর চোখের রেটিনা ও মস্তিষ্কের করটেক্সের সৃষ্ট বৈদ্যুতিক সিগন্যালের ব্যাপকতা পরিমাপ করে দেখেন। তারা লক্ষ্য করেন যে, নীল ও লাল আলোয় রেটিনা ও করটেক্স উভয়েই সবচেয়ে বড় সংকেত এবং সবুজ আলোয় সবচেয়ে ছোট সিগন্যাল তৈরি হয়। বাতের রোগীদের জন্য সুখবর রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস বা গেঁটে বাত এক প্রদাহজনিত রোগ যা একবার হলে আর সারে না। এতে গিটে গিটে ব্যথা হয়। জায়গাটা ফুলে যায়। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, আমাদের মস্তিষ্ক কা- থেকে তলপেট পর্যন্ত একটা নার্ভ আছে যার নাম ভেগাস নার্ভ। বৈদ্যুতিক প্রবাহের দ্বারা এই নার্ভটিকে উদ্দীপ্ত করে তোলা হলে গেঁটে বাতের ব্যথা ও ফোলা দুটোই উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। সূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট
×