ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রূপপুর পরমাণু কেন্দ্র

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের নামে ২৮ কোটি টাকা লোপাটের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের নামে ২৮ কোটি টাকা লোপাটের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত

স্টাফ রিপোর্টার, ঈশ্বরদী ॥ নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের পদ্মার চরের ৯৯০ একর খাস জমিতে আবাদকারী কৃষকদের ক্ষতিপূরণের নামে প্রায় ২৮ কোটি টাকা লোপাটের বন্দোবস্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে করে দেয়া নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে অকৃষকদের কৃষক দেখিয়ে ৭৭৫ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়ারম্যান ও কয়েকজন মেম্বার নির্দিষ্ট হারে কমিশনের অগ্রিম টাকা নিয়েছেন। এসব কারণে রূপপুরসহ পাকশী ইউনিয়নব্যাপী প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে এলাকাব্যাপী। অনিয়মের মাধ্যমে তৈরি করা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা বাতিল, সরকারী টাকা তছরুফ করা বন্ধ ও তদন্তের দাবি উঠেছে। একই সঙ্গে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিরও দাবি করা হয়েছে। পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ সদস্য সাইফুল ইসলাম বাবু ম-ল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এম রশিদ উল্লাহ, কৃষক মুক্তি, আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল ইসলাম মালিথা, ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস, ইউএনও নাসরিন আক্তার, কৃষি অফিসার রওশোনুজ্জামান, রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস ও দুদকে অভিযোগকারী কৃষক জুবায়ের বিশ্বাসের দেয়া তথ্যসূত্রে এসব জানা গেছে। সূত্রমতে, রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের জন্য চররূপপুর, পূর্ব বাহিরচর ও দিয়াড় রূপপুর মৌজার ১৯০ একর এবং রূপপুর কণিকা মৌজার ৮০০ একর মিলে মোট ৯৯০ একর জমি সরকার বরাদ্দ দেয়। বরাদ্দকৃত মোট জমির অর্ধেকই ধুধু বালুচর। পদ্মার এই চরে বছরে ৪-৫ মাস পানি থাকায় কোন চাষাবাদ হয় না। অথচ ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য ৭৭৫ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ১৯০ একর জমির অনুকূলে ১৫০ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের জন্য ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে দুই কোটি ৭৫ লাখ ৪৯ হাজার ৮৫০ টাকা। অপরদিকে রূপপুর কণিকা মৌজার ৮০০ একর জমির অনুকূলে ৬২৫ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের জন্য ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে ২৪ কোটি ৫৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৪০ টাকা। অর্থাৎ ৯৯০ একর জমির অনুকূলে ৭৭৫ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে মোট ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ টাকা। এ টাকা লোপাটের জন্য কমিশন গ্রহণের মাধ্যমে বেশির ভাগ অকৃষকের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ফসলের তালিকায় দেখানো হয়েছে শত শত বিঘা জমিতে পেঁপে ও কলার আবাদ করা হতো, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুয়া। একই ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে একাধিকবার নিজের নাম ক্ষতিপূরণের তালিকায় লিখিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তারা কৃষক নন এবং ক্ষতিগ্রস্তও হননি। আব্দুল্লা আল বাকির নামে তালিকার ক্রমিক নং-১০০, ১২১৫, ৫৫৮ ও ৬১৯-তে মোট ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫২০ টাকা ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে। মৃত কেরুর ছেলে আদম আলীর নামের ক্রমিক নং-৫৪৭ ও ৫৯৫-তে মোট ৩৫ লাখ ৪ হাজার টাকা এবং রহমান সরদারের ছেলে মন্টু সরদারের নামের ক্রমিক নং-৪৩১ ও ৫১০-তে মোট তিন লাখ ৮৭ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে। বরাদ্দকৃত জমিতে সরকার ফসলের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিলে প্রথমে যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, পরে সে তালিকা বাদ দিয়ে নতুন তালিকা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা লোপাট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুল ইসলাম বলেন, যে ব্যক্তি জীবনে চরে যায়নি তার নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকা প্রস্তুতে শতভাগ ভেজাল থাকায় আমি সম্পৃক্ত হইনি এবং আমাকে ওই কাজের জন্য ডাকাও হয়নি। পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ সদস্য সাইফুল ইসলাম বাবু ম-ল বলেন, প্রকৃত কৃষক ক্ষতিপূরণ পাক এটা আমি চাই। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এম রশিদ উল্লাহ বলেন, নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। দু’-চারজন ভুয়া কৃষকের নাম থাকতেই পারে, বাকিসব জেনুইন। পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জহুরুল ইসলাম মালিথা বলেন, এলাকার দু’-চারজন চরে আবাদ করত। ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস ও কয়েকজন মেম্বার নিজেদের লোকজনের নামে তালিকা করেছেন। টাকা নিয়ে ভুয়া কৃষকের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বরাদ্দকৃত টাকা লোপাটের জন্য। তালিকা প্রস্তুতের সময় জালিয়াতি করার জন্য লক্ষ্মীকু-া ইউপি চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরীফের সঙ্গে পাকশী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাসের একাধিকবার মতানৈক্য হয়েছে। তিনি সব বিষয়ের তদন্ত করার দাবি করেন। ঈশ্বরদীর ইউএনও নাসরিন আক্তার বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, থানা প্রশাসনের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। কৃষক মুক্তি বলেন, বরাদ্দকৃত জমির মধ্যে আমার ৫০ বিঘা জমি আছে, যে জমির এসএ রেকর্ড হয়েছে কিন্তু আরএস রেকর্ড হয়নি। আমিসহ এলাকাবাসী ১৯০ একর জমির মালিকানা দাবি করে ৮-১০ বছর আগে হাইকোর্টে রিট মামলা করেছি (নং-৭৩৭৩/১০)। পাকশী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস বলেন, অভিযোগ সঠিক নয়। মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া তালিকা অনুযায়ী গঠিত কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ক্ষতিপূরণের তালিকা তৈরি করেছে। দুদক পাবনার ডিডি আবুবক্কর বলেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা, ভুয়া কৃষক ও ফসলের তালিকা বাতিল এবং ভুয়া তালিকা প্রস্তুতকারী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এক ব্যক্তি আবেদন করেছেন। আবেদনটি তদন্তের অনুমতিপ্রাপ্তির জন্য ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
×