ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৮ আগস্ট ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

রাজধানী ঢাকার সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের একেবারে প্রাণকেন্দ্র বলা যায় শিল্পকলা একাডেমিকে। সরকারী এ প্রতিষ্ঠান নাটক চারুকলা নৃত্য সঙ্গীত চলচ্চিত্র আবৃত্তিসহ সকল অঙ্গনের শিল্পীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। সেগুনবাগিচায় অবস্থিত একাডেমিতে অনেকগুলো মিলনায়তন। প্রতিটি মিলনায়তনে নিয়মিতই চলে উৎসব অনুষ্ঠান। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষ এখানে আসেন। উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদি উপভোগ করেন তারাও। অথচ সংস্কৃতির প্রিয় অঙ্গনটিকে যারপরনাই শ্রীহীন করে রাখা হয়েছে। অস্বস্তিকর পরিবেশ আর চরম অব্যবস্থাপনা দেখে হতবাক হয়ে যেতে হয়। কোন কর্তৃপক্ষ আছে তো? মনে সংশয় জাগে। শিল্পকলা একাডেমির বিশাল পরিসর। বিস্তৃত খোলা চত্বরের দুই প্রান্তে নতুন পুরনো মিলিয়ে কয়েকটি ভবন দাঁড়িয়ে আছে। এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের যথেষ্ট দূরত্ব। বিষয়গুলো মাথায় রেখেই তিন দিক থেকে চত্বরের প্রবেশ করার জন্য মোট ৪টি প্রবেশদ্বার করা হয়েছিল। কিন্তু এখন ৩টি গেটই সারাদিন বন্ধ থাকে। এর ফলে বিড়ম্বনা কত তা নিয়মিত যাতায়াতকারীই জানেন শুধু। হ্যাঁ, নিরাপত্তা ইস্যুতেই গেটগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তাই বলে জাতীয় নাট্যশালায় প্রবেশের পথটি বন্ধ রাখতে হবে? রাখা হলোইবা, সেটি প্রতিদিন কত সময়ের জন্য বন্ধ রাখা সমীচীন? সন্ধ্যা ৬টায় নাটক শুরুর আগে আগে গেটটি খুলে দেয়া হয়। মাঝখানের সময়টাতে বড় বিপদে পড়ে গেলেও গেট খুলে দেয়ার কোন লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। দুর্বল শরীরের প্রবীণরা কিংবা রিহার্সালে আসা নাট্যকর্মীরা কি গেটটি ব্যবহার করতে পারবে? কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই। এভাবে মুক্ত পরিবেশটি নষ্ট করা হচ্ছে। প্রায় সিলগালা করে রাখা হচ্ছে একাডেমি চত্বরটিকে। অথচ মাদকাসক্ত ভবঘুরে যারা, দিব্যি ঢুকে যাচ্ছে। কফি হাউস নামে যে দোকানদারি, সেখানে ভদ্রলোকের বসার কোন অবস্থা নেই। কোন কালেই ছিল না। অজানা অচেনা লোকজন এসে অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ করে রাখে। এখান থেকে সীমান প্রাচীর ঘেঁষা ঘিঞ্জি জায়গাগুলোর দিকে তাকালেই চোখে পড়বে ফেনসিডিলের পরিত্যক্ত বোতল! একাডেমির খোলা চত্বরটিও জঙ্গলের চেহারা পেয়েছে। একটু কেটে ছেঁটে সুন্দর করে রাখার কেউ নেই। এদিকে দিনের বেলায় নানা কার্যক্রম চললেও, মূলত সন্ধ্যে বেলায় জমজমাট হয়ে ওঠে একাডেমি প্রাঙ্গণ। আর তখন শিল্পকলা একাডেমির দুরবস্থা আরও ভালভাবে দৃশ্যমান হয়। দুটি প্রবেশ পথের উভয় অংশেই বড় বড় অক্ষরে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি’ লিখে রাখা হয়েছে বটে। দৃশ্যমান হয় কেবল ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি। ‘শিল্পকলা একাডেমি’ চলে গেছে অন্ধকারের পেটে! ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ডের অধিকাংশ আলো জ্বলে না। কয়েকটি বাতি জ্বলছে। এ অবস্থায় ভয়ঙ্কর বিচ্ছিরি একটি চেহারা দেখতে দেখতে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। দূর থেকে তাকালেও কর্তৃপক্ষের রুচি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। একজন নাট্যকর্মী বলছিলেন, এখন শিল্পকলা একাডেমির ঢের টাকা পয়সা। বড় বড় প্রজেক্ট প্রকল্পের অভাব নেই। কিন্তু রুচির দুর্ভিক্ষ কে ঘুচাবে বলুন? কেউ কেউ ভাবতে পারেন, ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ডের বাতি নষ্ট হয়েছে, ঠিক করা যাবে। ঠিক করতে কতক্ষণ? তাদের জন্য বলাÑ এই দুরবস্থা চলমান আছে বহুকাল ধরে। কিন্তু দেখার মতো কেউ নেই। ভেতরের অবস্থাটি সম্পর্কে এবার একটু বলা যাক। সব বলা যাবে না। একটু তো বলা যাক। জাতীয় নাট্যশালার বিশাল ভবন। আধুনিক ভবনে একাধিক মিলনায়তন। সেমিনার কক্ষ আছে। আছে মহড়া কক্ষ। কোনটি কত তলায়? কোন দিক দিয়ে যেতে হবে? না, কোন নির্দেশনা নেই। দুটি লিফটের কোনটি কখন চলবে? বন্ধ কখন? কে জানাবে? হ্যাঁ, যারা নিয়মিত আসা যাওয়া করেন তারা নিজের প্রয়োজনেই জেনে নিয়েছেন। নতুন কেউ আসলে বিড়ম্বনার কোন শেষ নেই। নাটক দেখতে আসা সাধারণ দর্শকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ শুনতে হয় নিয়মিতই। প্রায় প্রতিদিনই একসঙ্গে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার ও স্টুডিও থিয়েটারে। যানজট ঠেলে শেষ মুহূর্তে টিকেট সংগ্রহ করে কেউ পরীক্ষণ থিয়েটার হল খুঁজে পাচ্ছেন না। কেউ হন্যে হয়ে খুঁজছেন স্টুডিও থিয়েটার। এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত নতুন দর্শকদের বিড়ম্বনা দূর করার সামান্যতম উদ্যোগ নেই। এমনকি সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে যে, তেমন লোক নেই। কিছুদিন আগে সুবচনের ‘মহাজনের নাও’ নাটকটি দেখতে এসে এক দম্পতি তো রেগে মেগে অস্থির। বললেন, শিল্পকলা একাডেমির অবস্থা এমন হতে পারে? আমরা স্টুডিও থিয়েটারে যাব। কত লোককে যে জিজ্ঞেস করতে হলো! নামার সময় আরও বাজে অভিজ্ঞতা। একদম কাছে যে লিফটটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়ার কথা, সেটি বন্ধ পাওয়া গেল। পাশের সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইল ফোনের আলো জ্বালিয়ে নেমে আসতে হলো। তাও ভয় হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত নামতে পারব কিনা! নিচ তলায় গিয়ে যদি দেখি, গেট বন্ধ! একটু পেছনে ফিরে গিয়ে তারা বললেন, এর আগে রমজানের ঈদের ছুটির পর শিল্পকলা একাডেমির দেয়া শিডিউল দেখে নাটক দেখতে এসেছিলাম। এসে দেখি, কোন হল খোলা নেই। নাটকের নাম দলের নাম তারিখ সব একাডেমির দেয়ালে টানানো বোর্ডে লেখা রয়েছে। হল বন্ধ। কেন? জানার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। গেটে ইউনিফর্ম পরা গার্ড। তারা আমাদেরকে বোকা সোকা লোক ভেবে রীতিমতো হাসছিল। শিল্পকলা একাডেমির ওয়াশরুমগুলোর অবস্থা কি বলে বোঝানো যাবে? এক কথায় করুণ। দুর্গন্ধে টেকা যায় না। এ জন্য ওয়াশরুম পর্যন্ত যেতেও হয় না। পরীক্ষণ থিয়েটারের লবিতে বসলে বাতাসের সঙ্গে নাকে এসে লাগে দুর্গন্ধ। নাটক শুরুর আগে পর্যন্ত সেখানে দম বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। স্টুডিও থিয়েটার থেকে বের হলে মনে হয়, বাথরুমের গন্ধে ভেতরের সব বের হয়ে আসবে! এর পরও ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন দর্শক। আর তখন দেখা যায়, অনেকগুলো বেসিন। কিন্তু একটি বা দুটির বেশি ব্যবহার করা যায় না। অধিকাংশই জল জমে নোংরা হয়ে আছে। পানির ট্যাপ নষ্ট। এত কিছু। এত কিছু। দেখার কেউ নেই। নেই যে, তা আরও একবার বোঝা গেল একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীকে ফোন করে। যথারীতি ফোন বাজল। ধরলেন না তিনি! এবার শোকের মাস আগস্টের কথাটি। মঙ্গলবার ছিল কালো দিন ১৫ আগস্ট। এদিন রাজধানীবাসী জাতির জনকের প্রতি তাদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ভালবাসা জানিয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেনÑ তোমার দিকে ওরা ছুঁড়ে দিয়েছিল মৃত্যু,/কিন্তু ওরা জানতো না,/কোন কোন মৃত্যু জীবনের চেয়েও সতেজ মহিমান্বিত,/তোমার মৃত্যুর কাছে কোটি কোটি জীবন আজো নতজানু...। নতজানু হয়েছিল বাঙালী। শোক নয় শুধু, শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল ১৫ আগস্টকে। এখনও সেই রেশ রয়ে গেছে। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে স্মরণ করা হচ্ছে বাঙালীর মহান নেতাকে।
×