ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজালালে আধুনিক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৩ আগস্ট ২০১৭

শাহজালালে আধুনিক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই

আজাদ সুলায়মান ॥ একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে ধরনের অগ্নিনির্বাপনী ব্যবস্থা ও সাজ-সরঞ্জাম থাকা বাধ্যতামূলক, তার কিছুই নেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিস্ময়কর হচ্ছে- আগুন লাগলে জরুরী নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ফায়ার এসেম্বলি পয়েন্ট নেই। বের হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বহির্গমন দরজা বা ইমার্জেন্সি এক্সিট গেট নেই। আর আধুনিক বিশ্বের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপনী কিটের নামই শোনেননি বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কর্তারা। জনবল ও প্রশিক্ষণের অভাব তো গতানুগতিক আর দশটা সরকারী প্রতিষ্ঠানের মতো এখানেও প্রকট। সেই মান্ধাতা আমলের কয়েকটি ফায়ার এস্টিংগুইশার ও হাইড্রেন ছাড়া তেমন কিছু নেই। এ ধরনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবেই মূলত শুক্রবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল টার্মিনালে তিন তলার একটি রুমে আগুন লাগে। যার ভয়াবহতা তেমন না হলেও আতঙ্কের দরুন বিমানবন্দরের সব ধরনের কাজ বন্ধ রাখতে হয় ৩ ঘণ্টা। আগুন লাগার দ্বিতীয় দিন শনিবার ঘটনাস্থল ও বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। অগ্নি বিশেষজ্ঞদের মতে-শাহজালালে এত কিছু ছিল না এটাই থলের বিড়ালের মতো বেরিয়ে এসেছে শুক্রবারের অগ্নিদুর্ঘটনায়। এ ঘটনায় দুটো তদন্ত কমিটি শনিবার থেকেই কাজ শুরু করেছে। তদন্তকারীরা এদিন অকুস্থল পরিদর্শন করেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিনির্বাপনী ব্যবস্থা কেমন জানতে চাইলে পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, গোটা বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি আছে তেমনটা বলা যাবে না। তবে মোটামুটি বলতে পারেন- আগুন লাগার প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে যা যা থাকা দরকার সেগুলো আছে। যেমন ২৫০টি ফায়ার এস্টিংগুইস ও ২৭টি হাইড্রেন। এলার্মিং সিস্টেমও আছে। শুক্রবার এগুলো দিয়েই আগুন নেভানো হয়। প্রথমে বিমানবন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব সরঞ্জামাদি ব্যবহার করেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তারপর ফায়ার সার্ভিসের টিম এসে সহযোগিতা করে। যদিও এখানে বড় ধরনের কোন আগুন ছিল না। তারপরও সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় ত্বরিতগতিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা হয়েছে বিমানবন্দরকে। আগুন লাগার পর দ্রুত নিরাপদে বের হবার জন্য ফায়ার এক্সিট আছে। তবে এগুলোর জন্য সাইনএজ নেই। তিনি এমনটি দাবি করলেও বাস্তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে- চিত্র ভিন্ন। আইকাওর মানদ- অনুযায়ী এ ধরনের একটি বিমানবন্দরে প্রথমেই থাকা দরকার স্মোক ডিটেক্টর। যার কাজ হচ্ছে কোন রুমে বা রুমের আশপাশে যে কোন স্থানে আগুনের সূত্রপাত হিসেবে যে ধুয়া নির্গত সেটার সতর্ক শব্দ করা। যা শুনে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে আগুন নিভানোর কাজে লেগে যেতে পারে। শাহজালালে এ ধরনের স্মোক ডিটেক্টর আদৌ আছে কিনা জানতে চাইলে কাজী ইকবাল করিম বলেন, ফায়ার এলার্মিং সিস্টেম আছে। যার সিগন্যাল পেয়েই শুক্রবার আগুনের সংবাদ প্রথম জানা যায়। এ সম্পর্কে শাহজালাল ফায়ার ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, ফায়ার এলার্মিং সিস্টেমে এখন অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি দুনিয়াব্যাপী ব্যবহৃত হয়। সেগুলোর ধারে কাছেও নেই শাহজালাল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিশ্বব্যাপী আন্তার্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বহির্গমন ও আগমনী লাউঞ্জের পাশেই থাকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল বা ফায়ার এসেম্বলি পয়েন্ট। যেখানে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বা আগুন ছড়িয়ে পড়লেও দ্রুত নিরাপদে যাত্রী সাধারণ ও অন্যরা আশ্রয় নিতে পারেন। আগুন না নেভা পর্যন্ত কিংবা তাদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত ওই পয়েন্টেই নিরাপদে থাকা যায়। সব কিছু পুড়ে গেলেও ওই পয়েন্টে আগুন ভেদ করা খুবই কঠিন। এমন একটি এসেম্বলি পয়েন্ট শাহজালালে নেই। এ বিষয়ে বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, আশ্চর্য লাগে যখন শুনি শাহজালালের মতো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভেতরে নেই যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য কোন ফায়ার এসেম্বলি পয়েন্ট নেই। এখানে কর্মরত সবাইকে যে ধরনের অগ্নি প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার সেটাও দেয়া হয়নি। আইকাও রুলস রেগুলেশান অনুযায়ী আধুনিকায়ন করা হয়নি। বিমানবন্দরের নিজস্ব একটি ইউনিট রয়েছে যার কাজ মূলত উড়োজাহাজের অগ্নিদুর্ঘটনায়। কিন্তু টার্মিনালের অগ্নি দুর্ঘটনায় কি করণীয়, আগুন লাগলে কিভাবে দ্রুত তা নিভাতে হয়, সেখানে কি ধরনের ইকুপমেন্ট ব্যবহার করতে হয় সেটাই এখন খতিয়ে দেখতে হবে। যদি না থাকে তাহলে কেন এত দিনে করা হয়নি সেটাও আমলে নিতে হবে। জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিসের সাহায্য ছাড়া আগুন নেভানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে ‘ফায়ার স্প্রিংকলার পয়েন্ট। এটা প্রতিটা ফ্লোরের সিলিং পয়েন্টে থাকে। এর কাজই হচেছ আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয় ওপর থেকে ঝর্নার মতো পানি ছড়ানো। এটা থাকলে শাহজালালে শুক্রবারের আগুন লাগার পর এতবড় অচলাবস্থা দেখা দিত না। এ সম্পর্কে বিমানের জিএম সেফটি সিকিউরিটি ও কোয়ালিটি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, আগুনের ধরন কি সেটার ওপর নির্ভর করে কোন ধরনের সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে হবে। আগুন যদি ইলেকট্রিক্যাল হয় তাহলে পানিজাতীয় কোন পদার্থ দিয়ে সেটা নিভানো যাবে না। যদি দাহ্য পদার্থ থেকে হয় সেক্ষত্রেই কেবল পানি ছিটানো স্প্রিংকলার সিস্টেম ব্যবহার করা যায়। শাহজালালে কি ধরনের আগুন কিসে থেকে লেগেছে সেটা এখনও অজানা। তদন্তে সব বেরিয়ে পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে নিজস্ব একটি পরিপূর্ণ ফায়ার ইউনিট রয়েছে। এটা সাধারণত উড়োজাহাজে অগ্নিদুর্ঘটনার কাজের মূল দায়িত্ব পালন করে। আইকাও মানদ- অনুযায়ী প্রতি ৩ বছর পর পর এখানে অগ্নিদুর্ঘটনা মহড়াও দেয়া হয়। কিন্তু বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল ও অপর্যাপ্ত। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ও যন্ত্রপাতি নেই। টার্মিনালের প্রতিটি ফ্লোরে হাতের নাগালের কাছে শুধু ফায়ার এস্টিংগুইস ও হাইড্রেন ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই। বিমানবন্দরের কতজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে- তারও কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কাজী ইকবাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, শুক্রবারের ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু হয়েছে। আগুন লাগার কারণ বের না করা পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। এখানে কি ছিল না কি আছে সেগুলো তদন্তে ওঠে আসবে। কোন ধরনের ঘাটতি বা ত্রুটি থেকে থাকলে সেটাও খতিয়ে দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান বেবিচকের পরিচালক (প্রশাসন) সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আগুন কিভাবে লেগেছে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুক্রবার দুপুরে বিমানবন্দরে লাগা আগুন বিকেলে নিয়ন্ত্রণে আসার পর পাঁচ সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বেবিচক পরিচালক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সংস্থার সহকারী পরিচালক আবু সালেহ মোঃ খালেদ (অগ্নি), নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার মোর্শেদ, ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান ও এনএসআইয়ের প্রতিনিধি ননী গোপাল রয়েছেন। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস থেকেও তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধনকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পরপর বেলা দেড়টার দিকে বিমানবন্দরের মূল ভবনের তৃতীয় তলায় এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও গোটা বিমানবন্দর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল যে তিন ঘন্টা বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ ঘটনার একদিন পর শনিবার বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তা একেএম রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ফায়ার কন্ট্রোল মনিটরের আগুনের সূত্র হিসেবে এয়ার ইন্ডিয়া অফিস চিহ্নিত হয়। আগুনে এয়ার ইন্ডিয়া ও পাশের কাতার এয়ারওয়েজের অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দুটি এয়ারলাইনসের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিমানবন্দরে সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়েছে বিমানবন্দরে লাগা আগুনে প্রায় তিন ঘণ্টা বহির্গমন কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর অন্তত দেড় ডজন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিলম্বিত হয়। তবে ওই সময়ে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে কোন বিঘœ ঘটেনি। এদিকে আগুন লাগার ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে সিভিল এভিয়েশনের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রধান বেবিচকের পরিচালক সাইফুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আগুন কিভাবে লেগেছে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তদন্ত কাজের শুরুতেই বলা যাবে না কিভাবে কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত। পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বেবিচক পরিচালক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সংস্থার সহকারী পরিচালক আবু সালেহ মোঃ খালেদ (অগ্নি), নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার মোর্শেদ, ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান ও এনএসআইয়ের প্রতিনিধি ননী গোপাল রয়েছেন।
×