ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের নরম আঙুল হাত রেখেছে ছুটির কড়াতে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২২ জুন ২০১৭

ঈদের নরম আঙুল হাত রেখেছে ছুটির কড়াতে -স্বদেশ রায়

মন আমার কে? তাকে কোনদিন দেখতে পাইনে অথচ গাছের পাতার ওপর সূর্যের আলোটি পড়ে যখনই ঠিকরে নানান রং ধরে তখনই মনটা নেচে ওঠে। মনের নাচনটি আগে ঘটে আমি নেচে উঠি পরে। দেহের ভিতর দিয়ে বয়ে যায় শিহরণ- ততক্ষণে মন তার ভাল লাগার দেনা পাওনা মিটিয়ে ফেলেছে। শরীরের প্রয়োজনে আমরা সারাক্ষণ ছুটছি, সে ছোটাছুটিতে কোন ছুটি নেই। আজ রাতে যে কাজটি করে এলাম কাল সকালে তার থেকে অন্য একটি কাজ করার তাগিদ নিয়ে রাত কাটানো। রাতটুকুতে ছুটি আনতে পারে খুব কম মানুষ। রাজহাঁসের মতো পানি গায়ে না লাগিয়ে পানির ভিতর বাস করতে পারে আর ক’জনা। প্রায় সবাই তো পানিতে নামলে শরীর পানিতেই ভিজিয়ে ফেলে। সারাক্ষণ শরীরে পানি লেগে থাকে। তাই ছোটাছুটির মাঝে তাদের ছুটি নেই। সত্যিকারে ছুটি পায়, যখন কাজ থেকে একটা ছুটি আসে। নিত্যদিনের কাজটি বন্ধ হয়, কাজ বলে দেয় এ ক’দিন তার ছুটি তখনই কেবল সে ছুটি পায়। আর এ ছুটিটি কে পায়, তার শরীর না মন? শরীর যদি ছুটি পেতো তাহলে তো ক্লান্ত শরীরকে আরাম দেবার জন্যে যে ক’দিন ছুটি পেয়েছে ওই ক’দিন টানা বিছানায় পড়ে থাকত। এ কারণে ছুটির ছোটাছুটি দেখেই বোঝা যায় ছুটি পায় তার মন। তাই তো ছুটি পাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা নাচন লাগে, কোথায় যে লাগে তা বুঝতে পারে না। আর যদি হঠাৎ ছুটি না হয়ে ছুটি আসার একটা আয়োজন থাকে, তাহলে তো মন একটু একটু করে জাগতে থাকে। আর তো দুদিন পরেই ঈদের ছুটি। না, এ ছুটিটি একদিনে আসেনি, হঠাৎ করে আসেনি। বছরের প্রথমেই সে বলে দেয়, তোমার কিন্তু ওই দিন থেকে ছুটি হবে। তারপরে আসে একটা মাস। মাসজুড়ে অনেক ব্যস্ততা, অনেক পালনকর্ম, তারপরেও মনের সামনে উড়তে থাকে ছুটির রঙিন পাখনাখানি। একটা করে দিন যায় আর সে যেন একটু একটু করে পাখনা মেলতে থাকে। যেন বাড়তে থাকে খাঁচার ময়না পাখির পালকগুলো দিনে দিনে। আহা! প্রতিদিনেই যেন তাতে রঙের বাহার। আর এই রং বাহার শেষ করেই এখন একেবারে পুরো পাখনা মেলেছে ছুটিটি সামনে। মাত্র খাঁচার দুয়ারটি খুললেই সে উড়ে যাবে। এত দিনের পোষা ময়না উড়তে পারবে তো? যে পোষা ময়নাটি একেবারে পোষ মেনে গেছে, শরীর তার ভারি হয়ে গেছে, সে উড়তে পারে না। কিন্তু যার শরীর এখন ভারি হয়নি, যার সব পালকে এখনও রং লাগেনি, তার কিন্ত খাঁচার মুখ খুললেই একটা পাখনায় হলেও রং লাগবে। ছুটিতে গ্রামের বাড়ির দিকে যখন ছুটে চলবে বাস বা ট্রেন সে ঠিকই বিলের ভিতর বৃষ্টিকে ঝরতে দেখেই বলবে, মা দেখ দেখ কেমন বৃষ্টি! কতদূর জুড়ে না বৃষ্টি হচ্ছে! বাসের ভিতর বসে থাকলেও সে তখন ওই মাঠে। মায়ের মনটি যদি তখনও ভারি না হয়ে ওঠে তবে কোন একদিন কলেজ ফেরার পথে এমনই বৃষ্টি মাথায় ছিঁড়ে ছিল একটি কদম ফুল, সেই দিনটি নতুন হয়ে এসে দাঁড়াবে চোখের সামনে। চাকরি আর সংসারের আরেক চাকরির চাপে এতদিনে যে কদম ফুলটির কথা সে গিয়েছিল ভুলে- বাসের ভিতর বসে, বাসের শার্শিতে আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর সে তখন দেখতে পাবে কদম ফুলের পাপড়ি আর তার সঙ্গে সেই ঘন সবুজ রঙের পাতা। যেমন সে নিজেও ছিল এক সময়। আর যে এই ছুটিতে পরিচিত নয়, ছুটছে অপরিচিতের সন্ধানে, তার মনের ভিতর খেলা করছে ইচ্ছে খুশির রঙের তুলি। সে এখন বেহিসাবী, হিসাব করে তাকে কোন কিছু করতে হবে না। হিসাব করে কোন জিনিস নিয়ে কোথাও পৌঁছাতে হবে না, সালাম করতে হবে না শ্রেণীভেদে। সে গিয়ে থামবে পাহাড়ের পাশে, না হয় নদীর ধারে আর হয়ত বা যেখানে সাগর আর পাহাড় এসে দুজন দুজনকে করেছে যুদ্ধে আহ্বান ঠিক সেখানে। অচেনা এই পথটিই আজ তার হচ্ছে চেনা, অচেনা নদীটি আজ হচ্ছে তার নিজের নদী। দিনের পর দিন যে পা দুটো একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে একই অফিসে গেছে, দেখেছে একই মুখ প্রতিদিন। জীবনানন্দের ভাষায়Ñ এই ব্যবহৃত হয়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যাওয়া জীবনে হঠাৎ একটা নতুন নদী, তা হোক সে মাতামুহুরী, বড় ছোট্ট নদী ! তার স্রোতও তখন নতুন হয়ে দেখা দেবে। মনে হবে, এতকাল সে কত নদী দেখেছে কিন্তু এমন স্রোতটি সে কোনদিন দেখেনি। সত্যি এমনই ঘটে। একবার এক ঘরকুনো কয়েকের পাল্লায় পড়ে বেশিদূর যায়নি, গিয়েছিল ক্ষেপুপাড়া। এসে বলেকি, আর তাঁর মন বসছে না এ শহরে। বরং সেখানেই সে চলে যেতে চায়। আহা! কী পানি, সাগর আর পানি। তাঁকে বলিনি, যে মানুষটি ক্ষেপুপাড়ায় আছে, আর প্রতিদিন তৈরি করছে মাটির পাত্র। তাঁর কাছে ওই সাগর আর মাটি মানেই- জীবন মাটি, মাটিই জীবন। এখানেই ছুটির রং, এখানে বেরিয়ে পড়ার রং আর এখানেই মানুষের মন। এই রং আর মনকে কেউ কোনদিনই দেখতে পেল না। একজন তো আমাকে বলল, ভাই আমার চিয়াং মাই গিয়ে মোটেই ভাল লাগেনি, ওই নির্জনতা মানুষের ভাল লাগে? হাফ ছেড়ে বাঁচি ব্যাঙ্ককে এসে। বুঝলাম তার মনটিকে কেউ কোনদিন অর্চনা করে জাগায়নি, তাই কেবল মাত্র মানুষের কোলাহলে সে নিজে বেঁচে থাকে। আবার আরেকজন বলল, সেবার ছুটি পেয়ে বালি দ্বীপে গিয়ে রাতটাকে তাঁর বেশি জীবন্ত মনে হয়। সারারাত যেন সাগর তার সঙ্গে কথা বলতে থাকে। বুঝলাম লোকটির ভেতর একজন শিল্পী পরিতোষ সেন আছে, পরিতোষ সেন দুঃখ সহে নিজেকে জাগিয়েছিলো; তিনি দুঃখ সইবার সাহস পাননি। দুঃখ সইতে সাহস লাগে; কার্লাইল তো কত আগে বলেছেন, দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা হচ্ছে প্রতিভা। তিনি বালিদ্বীপে গিয়ে কটেজে শুয়ে সারারাত সাগরের গর্জন শুনেছেন, গর্জনের ভিতর দিয়ে সাগরকে তাঁর ভাল লেগেছে কিন্তু পরিতোষ সেনের মতো সাগরের ভাষা বোঝার জন্যে সব ছেড়ে ছুড়ে তিনি ছুটি নেননি। জাগাননি তাঁর প্রতিভাকে। থেকে গেছেন সাধারণ। নেয়া হয়নি সাধারণের শহর থেকে ছুটি নিয়ে প্রতিভার অরণ্যে প্রবেশ করার সাধনার ব্রত। এ ছুটি নেয়ার ক্ষমতা কজনেরই বা থাকে। সংসারের কত বাহ্যিক সুখ, কত আয়েশ, কত আরাম এসব ছেড়ে ছুড়ে সাগরের ভাষা বোঝার জন্যে পরিতোষ সেনের মতো সবাই যদি বেরিয়ে পড়ত- তাহলে তো সংসারে আরেক ঝঞ্জাট বেধে যেত। তখন আবার সবাইকে শোনাতে হতো অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ। আসলে এই বন্ধন আছে বলেই মুক্তির আনন্দ বেশি। কাজের বোঝা আছে বলেই ছুটি অত রঙিন হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। তারপরেও কারও কারও বুকের ভিতর একজন ছোটখাটো শিল্পী লুকিয়ে থাকেন, তাই তো তিনি গভীর রাতে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসে বলেন, আহা কি রং! অন্ধকারই তাঁর কাছে তখন বড় একটা রং হয়ে ওঠে। প্রতিবার ঈদের আগে আমাদের টেলিভিশনগুলোর একঘেয়েমি রিপোর্ট : কয়েকটি বাচ্চা ও কয়েকজন নারী ও পুরুষের সামনে মাইক্রোফোন ধরে প্রশ্ন- কেন যাচ্ছেন এত কষ্ট করে ? আর ফিরলে কেমন কাটল ঈদ? এই চিরপুরাতন একঘেয়েমি রিপোর্টের মাঝেও ভাল লাগে কচি মুখগুলোর হাসি। তারা বলে, খুব আনন্দে কেটেছে গ্রামে। মনে মনে ভাবি, ও নিশ্চয়ই অপু দুর্গার মতো কোন ফাঁকা মাঠে একটা ভোঁ-দৌড় দিয়েছিল। এবার বর্ষা মাথায় নিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে যাচ্ছে ভাইরাল ফিভার আর চিকুনগুনিয়া। তারপরেও মনে মনে ভাবতে ইচ্ছে করছে, এই ঢাকা শহরে আটকে থাকা কোন দুর্গা ওখানে গিয়ে গাছের নিচে বর্ষায় ভিজছে, আর বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় রোমাঞ্চিত হচ্ছে তার শরীরের প্রতিটি কোষ। যেন বৃষ্টির সঙ্গে তার কতকালের শারীরিক যোগাযোগ। বৃষ্টির সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, গাছের পাতার সঙ্গে, গাছের পাতার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঢেউ, সাগরের ঢেউ সবার সঙ্গেই তো রয়েছে আমাদের চিরকালের যোগ, চিরকালের নাড়ির বন্ধন। আর এই বন্ধন এমন করেই বাঁধা যা প্রতিদিন বোঝার উপায় নেই। একে বুঝতে গেলে একটা ছুটি লাগে, সব কিছু থেকে মনকে টেনেটুনে বের করে এনে একটা ছুটি নিতে হয়। আবার সারাক্ষণ যখন ছুটি হয়, সে ছুটি হয়ে যায় ক্লান্তিকর, তরুণের কাছে যা ভারবাহী বেকারত্ব। তাই কাজের মাঝে ডুবে থেকে, কাজের সাগরের তলা থেকে ডুব দিয়ে উঠে হঠাৎ যদি একটা সোনালী সূর্যের রশ্মির মতো দেখা যায়Ñ ছুটি এসেছে আমার সামনে তখনই মন গেয়ে ওঠে, ও ভাই আজ আমাদের ছুটি। ঈদের ছুটি দুয়ারে এসে আস্তে করে কড়াটায় হাত দিয়েছে, তার নরম হাতের আঙুলগুলোর নাড়ায় কড়া বেজে উঠল বলেই, আর যেন কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তাই তো সবার গলায় একটি রিনি ঝিনি তাল উঠেছে, এই গেয়ে উঠলো বলে ছুটির গান। সবার ঈদের ছুটি হোক আনন্দের। তাই যে যেখানেই যাক না কেন, সেখানেই হোক তার মানস সরোবরে দু’পা ডুবিয়ে জল খেলা। [email protected]
×