ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দালালের খপ্পরে পড়ে এরা স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন

মেক্সিকোর জেলে আড়াই হাজার বাংলাদেশীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩০ মে ২০১৭

মেক্সিকোর জেলে আড়াই হাজার বাংলাদেশীর অনিশ্চিত ভবিষ্যত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ উন্নত জীবন-আকর্ষণীয় বেতনের আশায় চরম ঝুঁকি নিয়ে এবার আড়াই হাজারের বেশি বাংলাদেশী নাগরিক দালাল চক্রের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছে মেক্সিকো। দালাল চক্র মেক্সিকোর পথ ব্যবহার করে আমেরিকায় পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিয়ে গেছে। এই পথে আমেরিকা যাওয়ার সময় গত কয়েক বছরে আটক হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি বাংলাদেশী। বর্তমানে তারা মেক্সিকোর বিভিন্ন কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। বছরের পর বছর কারাগারে থাকলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ নেই। অনেকে দেশে ফিরতে চেয়েও ফিরতে পারছেন না। এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তাদের। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাইগ্রেশন মেক্সিকো (আইএনএম) সম্প্রতি এক জরিপে বলেছে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ২ হাজার ৭৯৯ বাংলাদেশী আটক হয়েছেন। অন্যদিকে, আমেরিকার বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির হাতে গত ছয় বছরে আটক হয়েছেন দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশী। মানবপাচার চক্র উন্নত ও সচ্ছল জীবনের লোভ দেখিয়ে স্বপ্নের আমেরিকায় পাঠাতে প্রতিজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নিচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশের অনেক মানুষের ধারণা আমেরিকা হচ্ছে স্বপ্নের দেশ। এই দেশে যেনতেনভাবে ঢুকতে পারলেই জীবন সুখও শান্তিতে ভরে যাবে। তাই তারা দালালদের কাছে তুলে দেয় লাখ লাখ টাকা। এক সময় নিজেদের দালালদের হাতে সঁপে দিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। তখন দালালরা তাদের যেখানে যেভাবে যা বলছে তাই তাদের করতে হচ্ছে। লোভে পড়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী মেক্সিকো জেলে আটক আছে এটা মেক্সিকোতে বাংলাদেশ দূতাবাসও জানিয়েছে। তবে ঠিক কত সংখ্যক নাগরিক মেক্সিকোতে আটক আছে তা দূতাবাসের কাছে জানতে হবে। অনেক বাংলাদেশী আমেরিকায় ঢুকতে পারে আবার অনেকে ঢুকতে পারেন না। আমেরিকায় ঢুকে গেলেই যে বিপদ কেটে যায় তাও কিন্তু না। আমেরিকার বর্ডার সিকিউরিটির হাতেও তারা আটক হন। মেক্সিকোতে আটকের ভয় সব সময় থেকেই যায়। এভাবেই স্বপ্নের দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশী নাগরিকরা বিপদে পড়ছেন। রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) কর্মকর্তা ড. সি আর আবরার জনকণ্ঠকে বলেন, মানবপাচার থেমে নেই। মালয়েশিয়ায় পাচার কমেছে। তবে অন্য দেশগুলোতে পাচার ঠিকই হচ্ছে। ইউরোপে পাচার করার জন্য লিবিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার আমেরিকায় পাচারের জন্য মেক্সিকোকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। আমি যতদূর জানি, মেক্সিকোর বর্ডারে আমেরিকা অনেক কড়াকড়ি টহল দিলেও দালালরা এ পথ দিয়েই নাগরিকদের পাঠিয়ে দিচ্ছে। যাদের ভাগ্য ভাল তারা আমেরিকার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে না। আর যাদের কপাল খারাপ তারা ধরা পড়ে যায়। তাদের জীবন কাটে জেল-জুলুমের মধ্য দিয়ে। এভাবেই দেশে দেশে মানবপাচার হচ্ছে। এদিকে, লিবিয়ায় ৩০০ বেশি বাংলাদেশী পাচার করা হয়েছে। এদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরি দেয়ার কথা বলে দালাল চক্র লিবিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল। কিন্ত পাচার হওয়া নাগরিকদের ভাগ্য মন্দ, তাদের আর ইউরোপ যাওয়া হয়নি। তাদের স্থান হয়েছে এখন লিবিয়ার কারাগারে। সাগর পাড়ি দেয়ার আগেই তাদের লিবিয়ার পুলিশের হাতে আটক হতে হয়েছে। দেশে মানবপাচার রোধে কঠোর আইন থাকলেও পাচারকারীরা আইনের ভয় পাচ্ছে না। দালালদের খপ্পরে পড়ে বিপজ্জনক পথে পাচার হতে গিয়ে অনেক মারা পড়ছেন। আবার অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানবপাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। মালয়েশিয়াতেও ট্রলার যোগে জীবনের ঝুঁকি নিযে এখনও অনেক মানুষ পাচার হচ্ছেন। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে প্রতিনিয়ত অনেক নিরীহ মানুষ পুলিশের হাতে আটক হয়। কিন্তু পাচারকারী কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। অভিযোগ উঠেছে পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। এ কারণেই পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মানবপাচার বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোন কাজ হচ্ছে না। মানবপাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানবপাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালদের মাধ্যমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখানে থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হযে পড়বে। সরকার মানবপাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই চলে। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রেফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। পাচারকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এখন শুরু হয়েছে লিবিয়াতে পাচার। লোভ দেখানো হচ্ছে-লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরির। লোভে পড়ে মানুষ দালালদের ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে অনিশ্চিত জীবনে চলে যাচ্ছে। কেউ হয় তো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। তবে বেশিরভাগই ঠাঁই হয় বিভিন্ন দেশের জেলখানায়। মানবপাচার নিয়ে কাজ করেন এমন কযেকটি সংগঠনের কর্মকর্তারা বলেন, চাকরির নামে পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানবপাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সর্বজনীন আইন প্রণয়ন করা জরুরী। তাদের অভিযোগ, প্রতিটি জেলায় পাচারের মামলা মনিটরিং সংক্রান্ত কমিটি থাকলেও এর বেশিরভাগের কোন কার্যক্রম নেই। এ ছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান না করা, আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলাগুলোর বিচারপ্রাপ্তি ক্রমেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের নাজুক আর্থসামাজিক অবস্থা, নিরাপত্তার অভাব, সমাজে বিদ্যমান নারী-পুরুষের অসমতা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারসহ নানা অসঙ্গতি মানবপাচার প্রতিরোধের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাচার রোধে অপরাধীর শাস্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সৃষ্টি করে চলছে প্রচলিত আইনে পাচারের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হওয়া। আইনটি স্পষ্ট হলে অনেক অপরাধী বিচারের আওতায় চলে আসবে।
×