ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানী দাবড়ে বেড়াচ্ছে মৌসুমি অপরাধীরা, সাবধান!

ভুয়া ডিবি পুলিশের উৎপাত বেড়েছে রোজার আগেই

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৬ মে ২০১৭

ভুয়া ডিবি পুলিশের উৎপাত বেড়েছে রোজার আগেই

শংকর কুমার দে ॥ সাবধান! ভুয়া ডিবি পুলিশের উৎপাত বেড়ে গেছে। রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে যেসব মৌসুমি অপরাধী রাজধানী দাবড়ে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এক শ্রেণীর অপরাধীও মাঠে নেমে পড়েছে। গত সপ্তাহে খোদ রাজধানীর রামপুরা থেকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ের ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপরাধী চক্র ছাড়াও এক ধরনের মৌসুমি অপরাধী মাঠে নামার খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান শুরু করেছে। ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডাকাতির জন্য দাবড়ে বেড়াচ্ছে ভুয়া ডিবি পুলিশ। তাদের কাছে থাকে ডিবি লেখা জ্যাকেট, ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, সিগন্যাল লাইটসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহৃত সরঞ্জাম। প্রথমে তারা ডিবি পুলিশ পরিচয় দেয়। তারপরই হয়ে যায় ডাকাতদল, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসী। নানা ধরনের অপরাধ করে বেড়ায় এসব ভুয়া ডিবি পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকাসহ ভুয়া ডিবি পুলিশের অপরাধ প্রবণতার এহেন উৎপাত বেড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ১৯ মে রাতে রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয় ১৬ ভুয়া ডিবি পুলিশকে। গ্রেফতারকৃতরা হলেনÑ মোঃ জুয়েল রানা, মোঃ ইয়াসিন, মোঃ বাদল, মোঃ মোমেন আলী, মোঃ শহিদুল ইসলাম, মোঃ ফিরোজ, সৈয়দ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ আলী ও মোঃ সবুজ। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, দুই রাউন্ড গুলি, দুটি চাপাতি, চারটি ছুরি, একটি ওয়াকিটকি, তিনটি ডিবি জ্যাকেট, দুটি হ্যান্ডকাফ, দুটি বেতের লাঠি, একটি ব্যাগ ও দুটি ডিবি স্টিকার উদ্ধার করা হয় এবং তাদের ব্যবহার করা দুটি কার ও একটি মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়। ডিবি পুলিশ পরিচয়ের সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সদস্যদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশ জানায়, রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে ভুয়া ডিবি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব কথিত সদস্য। সংঘবদ্ধ বেশ কয়েকটি চক্র সরকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের বেশভূষা ধারণ করে ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ করছে। এমনকি অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। তাদের বেপরোয়া অপরাধমূলক কর্মকা-ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। ডিবি পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া ডিবি পুলিশসহ কথিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সরা বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে ছদ্মবেশে অবস্থান নেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বের হলে সোর্সরা তার দৈহিক ও পোশাকের বর্ণনা মোবাইল ফোনে চক্রের সদস্যের কাছে পৌঁছে দিয়ে টার্গেটের পিছু নেন। সুবিধা মতো জায়গায় চক্রের ছদ্মবেশী সদস্যরা টার্গেটকে হুন্ডি ব্যবসায়ী অপবাদ দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে গাড়িতে তুলে নেয়। পরে নির্জন স্থানে গিয়ে টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে মারধর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। এই অপরাধীদের খপ্পরে পড়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেশভূষা থাকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো। সঙ্গে থাকে রিভলবার হোল্ডার, ওয়াকিটকি, হ্যান্ডকাফ, পুলিশ-র‌্যাব-ডিবির পোশাক, নামের ব্যাজ। বহনকারী গাড়িতে থাকে পুলিশ ও ডিবির স্টিকার। তাই শত শত মানুষের সামনে থেকে তুলে নেয়া হলেও কেউ তাদের প্রতিরোধ করে না। সূত্র মতে, ডিবি পরিচয়ে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মানুষকে অপহরণের চেষ্টা করে এই চক্র। পূর্বশত্রুতা উদ্ধারের জন্য প্রতিপক্ষরাও ব্যবহার করে ভুয়া ডিবি পুলিশের সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রকে। অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ করার সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে এমন ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয়ের অপরাধী চক্রকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। সম্প্রতি পল্লবী থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়দানকারী ৫ ডাকাতকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ডিবি লেখা জ্যাকেট, হ্যান্ডকাফ, সিগন্যাল লাইটসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। ডাকাতদলের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, তারা ডিবি পরিচয়ে বাসা বাড়িতে ঢুকে ডাকাতি করে। আর রাস্তায় বাস, প্রাইভেটকার থামিয়ে মালামাল লুট করে। এছাড়াও মাইক্রোবাস যোগে ব্যাংকের সামনে অবস্থান নিয়ে গ্রাহক বড় অঙ্কের টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় ডিবি পরিচয় দিয়ে তাদের আটক করে। পরে সুযোগ বুঝে টাকা লুট করে নিয়ে যায় তারা। ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি করার জন্য এই সংঘবদ্ধ দলের সদস্যরা ডিবি পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপরাধীরা ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করে ডাকাতি, ছিনতাই করছে। চাকরিচ্যুত অনেক পুলিশ সদস্যসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর ধানম-ি, মিরপুর, রামপুরা ও বিমানবন্দর থানায় এসব ঘটনায় একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা টিপরদি এলাকা থেকে ১০ ভুয়া গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হলেনÑ এনামুল হক, মিঠু খাঁন, হেলাল, শেখ মোজাম্মেল হোসেন, মনির হোসেন, মাসুদ রানা, মাসুদ করিম, নূরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ওরফে মোক্তার, কুদ্দুছ। এ সময় তাদের কাছ থেকে পুলিশ ও সাংবাদিক লেখা দুটি প্রাইভেটকার, এক জোড়া হ্যান্ডকাফ, ‘ডিবি পুলিশ’ লেখা ৩টি পোশাক, পুলিশের ব্যবহৃত দুটি লাঠি, একটি ওয়াকিটকি ও একাধিক ভুয়া ওয়ারেন্ট উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও মিঠু খান নামে এক পত্রিকার ভুয়া আইডি কার্ড ও হেলাল হোসেন নামে হিউম্যান রাইটসের একটি আইডি কার্ড উদ্ধার করা হয়। সোনারগাঁও থানার ওসি শাহ মোঃ মঞ্জুর কাদের বলেছেন, এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সোনারগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে আসছিল। তারা মানুষকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে নগদ অর্থসহ গাড়ি ও মালামাল হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। কয়েকদিন ধরে সোনারগাঁও থানা পুলিশ এ চক্রটিকে ধরার জন্য কাজ করছিল। সোনারগাঁও থানা পুলিশ ফাঁদ হিসেবে একটি বালুর বস্তা নিয়ে লেগুনা করে উপজেলার মোগরাপাড়া চৌরাস্তা থেকে কাঁচপুরের দিকে যাচ্ছিল। সোর্সের মাধ্যমে ওই চক্রকে জানানো হয় বস্তায় জমি বিক্রির ৬৫ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই চক্রটি দুটি প্রাইভেটকার নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের টিপরদী এলাকায় লিপা পেট্রোল পাম্পের সামনে লেগুনার গতি রোধ করে। লেগুনাতে সাদা পোশাকে থাকা সোনারগাঁও থানার এএসআই হাবিব ও উদয়কে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বস্তাসহ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা সোনারগাঁও থানা পুলিশের একাধিক টিম তাদের ঘটনাস্থলে থেকে আটক করে। এক গোয়েন্দা সংস্থা কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে শতাধিক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ওয়্যারলেস সেটের আদলে ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করছে। তারা বিটিআরসি থেকে অনুমতি নিয়ে ফিকোয়েন্সি ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এই ধরনের ১ হাজারেরও বেশি ওয়াকিটকি ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এই সুযোগে সংর্ঘবদ্ধ অপরাধীরা ওয়াকিটকি সেট সংগ্রহ করে নানা ধরনের অপরাধ করছে। সাধারণ মানুষ ওয়াকিটকি সেট হাতে দেখলে মনে করে, সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিবহন থেকে শুরু করে আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারবিরোধী অনেক রাজনৈতিক নেতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে বিটিআরসির অনুমতি নিয়ে ওয়াকিটকি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। অভিযোগ রয়েছে, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তারা অবৈধভাবে ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এই সুযোগে তারা বাসাবাড়িতে ঢুকে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে মালামাল লুট করে। প্রাইভেট সেক্টরের নিরাপত্তায় যাদের নিয়োগ দেয়া হয় তাদের মধ্যে অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিচ্যুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তাদের কারও সঙ্গে অপরাধীদের যোগসূত্র আছে। যার কারণে অনেক সময় অপরাধের কাজে ওয়াকিটকি সেটের অপব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়াও অনেকেই ওয়াকিটকি সেটের আদলে সেট ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে কৌশলে ডাকাতি করছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মিডিয়া মাসুদুর রহমান বলেছেন, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করে ডাকাতি করতে যাওয়া অনেক অপরাধীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে ওয়াকিটকি সেট, হ্যান্ডকাফসহ অন্য মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে। ডিবি পরিচয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সদস্যদের গ্রেফতারের বিষয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে।
×