আমি কবিতা লিখি নিজের অতীতের মধ্যে বসবাস করার জন্য। সেই অতীতের মধ্যে থাকছে নিজের যাবতীয় অমার্জনীয় অযোগ্যতা, ব্যর্থ প্রেমবোধ আর মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্মের কান্নাযুক্ত হাসির বিমর্ষ নাটকীয়তা। এদের মধ্যে কোনোটা আবার অকথ্য থেকে যায়। এসব বস্তুর মধ্যে আজীবন আমার জীবন যাপন।
কবিতা লেখাটা আমার পক্ষে খুব কঠিন কাজ, বিশেষত প্রেরণায় বিশ্বাসের ওপর ভরসা রেখে নব্বইভাগ পরিশ্রমের দিকে তাকাতেই ভালোবাসি। প্রকরণ ও বিষয়ের মিলমিশ ঘটাতে ঘটাতে কেটে যায় অনেকটা সময়।
ঐতিহ্য নামক শব্দটা আমাকে আগাগোড়া ভাবিয়েছে। আমি কবিতার আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। মারাত্মক ছন্দবাজ কবি হতে আমার মোটেও আপত্তি নেই। কারণ ছন্দই এক কবিকে আরেক কবির থেকে আলাদা করে দেয়।
কবিতা কি আকাশ থেকে নেমে আসে, নাকি কবির হৃদয়ে মুক্তার মতো ক্রমান্বয়ে জমতে থাকা সৌন্দর্যময় বস্তু? সেই সৌন্দর্যময়তা হতে পারে আস্তিকতা ও নাস্তিকতার আকারে। সমস্ত ঐতিহ্যবাদী কবির কবিতামালা ওভাবেই গড়ে উঠেছে। নির্জনতা স্বাভাবিকভাবে নেমে এসেছে আমার সৃজনশীলতায়। এটাই হয়ত আমার কবিতার ভবিতব্য। তবে কবিতা শেষ অবধি জনগণমুখিনতার দিকে অগ্রসর হলেই জুটবে তার মুক্তি। কারণ, কবিতার পাঠক তো শেষাবধি মানুষই।
আমি আশাবাদের পক্ষে। এই মতামতের ওপরেই আমার কবিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে। তবে প্রতিবাদকে ইদানীং আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, তারাও হুড়মুড় বাতাসের মতো করে ঢুকে পড়ছে। তাই আমি আতঙ্কিত হয়ে দিন যাপন করছি, কারণ, কতদিন নির্মোহভাবে নিখুঁতভাবে কবিতা লিখতে পারব জানি না। ভাল কবিতা লিখে যাওয়াটা কবির কাছে সব সময় মরণপণ সংগ্রামও বটে।
ভ্রমণ
পড়তে পড়তে যাবো নদীময় পাখিদের ভীড়;
দুপুর ডুবেছে ঘুমে, চলমান মানুষের মুখÑ
বেদনার প্রতিচ্ছবি, রহস্যের ললাট চিবুক।
উপরে আকাশ নেই, তবু স্বপ্ন আকাশ বাতির।
ভাবতে ভাবতে যাবো, ঘাসপাতা মাড়িয়ে ক্ষেত,
হৃদয়ে জমেছে ক্ষত, বৃত্তাবদ্ধ জীবনের ঝড়
নিবিড় নীলিমায় খুঁজে নেব জলের জঠর,
ভুলে যাবো দুঃখ শোক, নিদ্রাহীন আঁধারের প্রেত।
দেখতে দেখতে যাবো, লুপ্ত ধূসর সব গম্বুজ।
আকাশের কোলে তীব্র দীপ্র তারাদের মহফিল,
পৃথিবী এখনো ছেঁড়া-খোঁড়া এক জটিল ত্রিভুজ,
বাকি সব অচেতন, হৃদয় আমার গাঙচিলÑ
হয়ে উড়ে যাবো একা, ছুঁয়ে ছেনে সব পিলসুজ,
আরণ্য তিমিরে হব শেষ নাগরিক আবাবিল ॥
মুখ
দুরূহ জীবনে দুর্ভোগ শুধু। দুপুর বেলার রোদ্দুরে আঁকা
একটি মুখ,
আকাশের মত টলটলে চোখ, তবু কার খোঁজে আজ
তার সে নয়ন উৎসুক।
খুশির আভায় ডেকেছে আমাকে কাজলরেখার মত
ফাল্গুনে জীর্ণপাতা ঝরে ঝিরঝিরÑ
তুমি কেউ নয়। আমার স্মৃতি মেঘে মেঘে বেলা যাওয়া
ছিন্ন শতাব্দীরÑ
কুয়াশার মত দুরাশা নিয়ে ঘুমন্ত পৃথিবীকে মনে হয়
জোছনার পারফিউমÑ
দুরূহ জীবনে দুর্ভোগ শুধু, তবু রজনীর রোদ্দুরে আঁকা
একটি মুখ, ভালোবাসার মৌসুম॥
গাছ পুঁতে দাও
গাছ পুঁতে দাও বুকের ভেতরে
এবার সেটাকে সাজিয়ে রাখি
সাজানো বাগানে তোমরা দাঁড়িয়ে থাকো,
স্বপ্ন ভেসেছে প্রহরের ঘরে
হৃদয়ে ডেকেছে বেদনার পাখি,
সব ভেঙ্গে যাক হাতখানা তবু বাড়িয়ে থাকো।
দেখা যাক কারা পাঁচানির মাঠে
বিছিয়েছে ডালপালা?
গাছ পুঁতে দাও বুকের ভেতরে
বুকেই রয়েছে জ্বালা।
পরিতাপহীন নদীদের মত
ভেসেছে যৌবন রঙ্গ
সব ভেসে গ্যালো বহতা কাজের কলহে,
বুক ভেঙ্গে দাও বধিরের মত
স্বপ্নকে দাও সঙ্গ,
যৌবন যায়, আর দেরি নয় চলো হেÑ
পাঁচানির মাঠে জেগেছে আবার
জ্যোৎস্না জড়ানো বৃক্ষলতা
গাছ পুঁতে দাও বুকের ভেতরে
সরিয়ে দিয়েছি অলসতা।
বৃদ্ধেরা বলে
কিছুই থাকে না, সব ভেসে যায়, বৃদ্ধেরা আজো বলে
থাকে শুধু এই প্রেমে মাখানো হৃদয়ের লেনদেন,
ক্যানো যে যাইনা ভেসে মদির সফেন?
হৃদয়ে হৃদয়ে তার লুকোচুরি চলে।
আমি বহুবার ভেবেছি একাকী, তাকিয়েছি তার চোখে
চুলের খোঁপায়, কৃষ্ণপক্ষ ধরে
সূর্যোদয়ের সমস্ত রঙ দিয়েছি ছড়িয়ে। কোথায়? হৃদয়লোকে।
মৌমাছির মত কেবলই মধু ঝরে॥
এই চিরচেনা, পাখি পল্লব ফলন্ত গাছে গাছে,
মুছে যেতে চাই, মায়াময় কত ছবি,
কিছুই মানে না হৃদয়ের জাহ্নবী।
জানি এখনো কিশোরী হৃদয়ে আমাকেই গাঁথা আছে।
বৃদ্ধেরা বলে এই নীরবতা পলাশের মেঘ নাকি?
ও দেখায় শুধু দূরের আকাশ, রঙিন পাখিটাখি।