ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

কৌশল হিসেবে ভালো, মাথায় তোলা ঠিক হবে না

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৬ এপ্রিল ২০১৭

কৌশল হিসেবে ভালো, মাথায় তোলা ঠিক হবে না

ঢাকার একটি দৈনিকে (২৪ এপ্রিল) একটি খবর বেরিয়েছে। হেডিং ‘হেফাজত-বিএনপি গোপন যোগাযোগ বহাল।’ খবরে বলা হয়েছে, বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন কৌশলগত কারণে হেফাজত এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করলেও সাধারণ নির্বাচন এলে তারা বিএনপির সঙ্গেই থাকবে। তখনই তাদের আসল সখ্য কাদের সঙ্গে তা স্পষ্ট হবে। হেফাজত ইসলামী দল। নীতি ও আদর্শগত কারণেই দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেতে পারে না। নির্বাচনের ঘোষণা এলেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে। খবরটিতে বিএনপি নেতাদের বরাত দিয়ে এমন কথাও বলা হয়েছে যে, ‘হেফাজতে বিভক্তি আছে। একটি অংশকে আওয়ামী লীগ হাত করতে পারলেও বড় অংশটি যথাসময়ে বিএনপির জোটেই চলে আসবে। এই ব্যাপারে তারা নজির দেখিয়েছেন, অতীতে ইসলামী দল খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমঝোতা করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে ঠিকই তারা বিএনপির কাছে চলে এসেছে। আওয়ামী লীগ সেক্যুলারিস্ট দল। তার সঙ্গে কোন ইসলামী দল জোটবদ্ধ হতে পারে না।’ খবরটি এমন সময় প্রকাশিত হয়েছে, যখন হেফাজতী নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা হৃদ্যতাপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতীদের দাবি সম্পর্কে সরকার নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন এবং কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাকে সরকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছেন। খবরটির সূত্রও বিএনপি নেতাদের নানা রকম ভাষ্য। এই ভাষ্যতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে ‘তিন বছর আগে হেফাজতের সমাবেশের ওপর আওয়ামী লীগ সরকার যে তা-ব চালিয়েছিল তা হেফাজত ভুলতে পারে না এবং পারেনি।’ অর্থাৎ বিএনপি নেতারাই শাপলা চত্বরের ঘটনা হেফাজতের নেতাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সমঝোতা নষ্ট করতে চাইছেন। বিএনপি নেতারা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের এই সখ্যে তারা উদ্বিগ্ন নন।’ কিন্তু তারা যে উদ্বিগ্ন তা বোঝা যায় সুপ্রীমকোর্টের ভাস্কর্য নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরাতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে ওপরের খবরটি প্রকাশ এবং হেফাজত যে তাদের সঙ্গেই থাকবে সে কথাটি জোরেশোরে প্রচার করা। এর দুটি লক্ষ্য হতে পারে। আওয়ামী-হেফাজত সমঝোতায় ভীত বিএনপি চায়, তাদের সঙ্গে হেফাজত তলে তলে গোপন সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে এই খবর ফাঁস করে আওয়ামী লীগের মনে হেফাজতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করা এবং তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করা। দুই, শাপলা চত্বরের ঘায়ে খোঁচা মেরে হেফাজতের একটা অংশকে বিক্ষুব্ধ করা ও নিজেদের দিকে টানা। উদ্বিগ্ন বিএনপি এখন ‘ইসলামী আদর্শের’ দোহাই পেড়ে হেফাজতকে পুরোপুরি অথবা তার একাংশকে দলে টানতে চায়। আগামী নির্বাচনের সময় কোন্্ দল কোন জোটে যাবে তা একটা রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির ব্যাপার। সাধারণত, এই কৌশলের কথা আগে কেউ প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষিত না হতেই হেফাজতকে নিয়ে বিএনপির এই আগাম ভাষ্য দলটির মধ্যে উদ্বেগ ও দুর্বলতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জামায়াতকে প্রকাশ্যে জোটে রাখা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তারপর হেফাজতও যদি সঙ্গে না থাকে, তাহলে নামসর্বস্ব ২০ দলীয় জোট নিয়ে নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া অসম্ভব হবে। এ কথা জেনেই বিএনপি তড়িঘড়ি বলতে শুরু করেছে, ‘হেফাজত এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে গেলেও কী হবে? হেফাজত তলে তলে আমাদের সঙ্গে আছে।’ গোপন পিরিতি সময়েই প্রকাশ পাবে। শাপলা চত্বরের ঘটনা হেফাজতকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ক্ষেপানো যাবে আমার তা মনে হয় না। শাপলা চত্বরে সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল খুবই মৃদু। সরকার সেখানে তা-ব চালিয়েছে এই প্রচারণটা ছিল বিএনপির। এমনকি তারা প্রচার করেছিল দুই হাজার লোক হত্যা করে লাশ ভারতে পাচার করা হয়েছে। এই মিথ্যা ধোপে টেকেনি। হেফাজতীরাও জানে এটা মিথ্যা প্রচার তাদের দুই হাজার লোক নিহত হলে হেফাজতী হুজুর সরকারের দেয়া হেলিকপ্টারে হাটহাজারীতে ফিরে যেতেন না। সরকারের এত সুযোগ-সুবিধা দলের নেতারা গ্রহণ করতেন না। সেক্যুলার আওয়ামী লীগের সঙ্গেও মৌলবাদী হেফাজতের সখ্য হতে পারে না, এটাও বিএনপির ভ্রান্তি বিলাস। অবিভক্ত ভারতে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র দিল্লীর দেওবন্দের আলেমদের জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ্ প্রতিষ্ঠানটি কখনও মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন দেয়নি এবং সেক্যুলার কংগ্রেসকে সবসময় সমর্থন দিয়েছে। জিন্না বহু চেষ্টা করেও জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ্কে দলে টানতে না পেরে কিছু আলেমকে ভাগিয়ে এনে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলাম ও হেফাজতে ইসলামের মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের পার্থক্য কম। কিন্তু কর্মপন্থা ভিন্ন। সে জন্য ভারতের ওলামায়ে হিন্দ্রে কংগ্রেসকে সমর্থন দেয়ার মতো বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে তারা সমর্থন দিতে পারে। এটা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের কৌশল হতে পারে। আবার আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে, উগ্র মৌলবাদী জামায়াত এবং তাদের সাম্প্রদায়িক মিত্র বিএনপির সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ঠেকানোর জন্য হেফাজতের কিছু কিছু দাবির প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখানো। এর ভালো দিক এবং মন্দ দিক দুই-ই আছে। ভালো দিক হলো, বিএনপির রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র এবং জামায়াত ও উগ্র মৌলবাদী দলগুলোর সম্মিলিত সন্ত্রাসের মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার শত্রুদের শিবিরে ভাঙ্গন ধরাতে পেরেছেন এবং স্বাধীনতা ও সেক্যুলারিজমের পক্ষের শক্তিকে এখনও ক্ষমতায় রাখতে পেরেছেন। জামায়াতের শক্তির ভিত্তি একশ্রেণীর মসজিদ ও মাদ্রাসা। এদের ভোট বাক্স বিরাট। এই ভোট বাক্স যাতে পুরোপুরি বিপক্ষে না যায় সে জন্য ভারতে কংগ্রেসে সরকার থেকে বর্তমান বিজেপি সরকার দেওবন্দকে তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে দিয়েছেন এবং দিল্লীর শাহী মসজিদের কাছ থেকে সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মসজিদের খতিবদের কাছ থেকে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করেছেন। সিপিএমের কোন কোন নেতা নির্বাচনের সময় কালী মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়েছেন। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগের ভোটের রাজনীতির কৌশল এমনটা হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু এর একটা মন্দ দিক আছে। মৌলবাদীদের ঐক্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে তাদের ভোট বাক্সের ভাগ নিয়ে আওয়ামী লীগ যতটুকু লাভ করবে সেই লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে ফেলতে পারে। যদি আওয়ামী লীগের মৌলবাদবিরোধী ভোটারেরা দলটির নীতিতে বিরক্ত হয়ে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে না আসে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট না দেয়। আবার মৌলবাদী শিবিরে এখন ভাঙ্গন ধরানো গেলেও নির্বাচনের সময় তারা একজোট হয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না এর সম্ভাবনাটাই বেশি। এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই বিএনপি হেফাজতকে দলে রাখার জন্য আগাম খবর ও ভাষ্য প্রচার শুরু করেছে। অতীতেও আওয়ামী লীগকে পেছন থেকে অতর্কিতে ছুরি মারার রাজনীতির কথা আমরা জানি। একবার খালেদা জিয়ার সরকারকে হটানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। জামায়াত তাতে যোগ দিতে চায়। আওয়ামী লীগ তাতে রাজি না হলে তারা যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচী দেয়। শেখ হাসিনার এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আমন্ত্রিত না হয়েও গিয়ে হাজির হন। তাদের নির্ধারিত ফটোসাংবাদিক সেই ছবি তোলেন এবং সংবাদপত্রে তা ছাপা হয়। বাজারে হইচই পড়ে যায় যে, আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছে। বিএনপি এই প্রচারণায় হাওয়া দিতে থাকে। নির্বাচন শুরু হওয়ার পর জানা গেল, বাইরে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিলেও জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযম তার দলের সমর্থক ও সদস্যদের গোপনে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন বিএনপিকে ভোট দেয়। জামায়াতের এই হিপোক্রেসির রাজনীতির কথা জানা থাকতেই বর্তমানেও বিএনপি হয়তো ভাবছে জামায়াতের একই নীতি ও লক্ষ্যের অনুসারী হেফাজতও হয়তো নির্বাচনের সময় জামায়াতেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে এবং সেই আশায় বুক বেঁধে তারা এখনই প্রচার প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে। এখানেই আওয়ামী লীগকে তার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা রক্ষায় জন্য তারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে আঘাত না লাগে এমন আপোসের পথে কতটা এগুতে পারেন, তা অত্যন্ত ঠা-া মাথায় তাদের ভেবে দেখতে হবে। জামায়াতীদের ঠেকাতে গিয়ে যদি হেফাজতীদের কবলে পড়তে হয় তাহলে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলা গড়ার স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ব্রিটিশ ভারতে মহাত্মা গান্ধী খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সমর্থন দিতে গিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে হেফাজতীদের তোল্লা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা যেন সেই মহাভুল না করেন। প্রকৃত ধর্মের চর্চা আর তার নাম ভাঙ্গিয়ে অন্ধকার মৌলবাদী অতীতে ফিরে যাওয়া এক কথা নয়। ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস। তাকে রাজনীতিতে জড়ানোর ভয়ঙ্কর পরিণতি আমরা এখন সারা বিশ্বে দেখছি। আমরা পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে সরে এসেছি ধর্মীয় রাজনীতির ভয়ঙ্কর থাবা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। সে জন্য লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন যদি সেই ধর্মীয় রাজনীতির পাঁকে বাংলাদেশ আবার জড়ায় তাহলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং লাখ লাখ শহীদের অত্মদান ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমি শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কাছে আবেদন জানাই। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষে হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা ক্ষতিকর না হতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যযুগীয় দাবি-দাওয়াগুলোর সঙ্গে আপোস কিছুতেই নয়। এই আপোস করতে গেলে আওয়ামী লীগ আম ও ছালা দুই-ই হারাবে। লন্ডন, ২৫ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১৭
×