ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভাগ্য বদলে গেছে অসংখ্য ভূমিহীনের

তিস্তার চরে মিষ্টি কুমড়া চাষ

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২ এপ্রিল ২০১৭

তিস্তার চরে মিষ্টি কুমড়া চাষ

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ১ এপ্রিল ॥ চরের বালুকাময় জমিতে ফসল ফলানোর চিন্তা খুব একটা ফলপ্রসূ নয়। তাই দীর্ঘদিন ধরে পতিত ছিল রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার চরগুলো। অনাবাদি হওয়ার কারণে এ চরগুলোর কোন খোঁজখবর রাখেননি জমির মালিকরাও। তবে আশপাশের ভূমিহীনরা এ চরের জমিতে মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন। তাদের প্রচেষ্টায় কাউনিয়ার ৫টি চরে এখন মিষ্টি কুমড়ার চাষ হচ্ছে। ধু ধু বালুচরে যতদূর চোখ যায় চরজুড়ে এখন সবুজ কুমড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে সোনালি মিষ্টি কুমড়ার সমারোহ। বেসরকারী সংস্থা ‘প্রাকটিক্যাল এ্যাকশন’ চরের জমিতে ফসল চাষে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে। উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে তারা এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা কৃষিবিদ নির্মল চন্দ্র ব্যাপারী জানান, ২০১৪-১৫ সাল থেকে ইউএসএআইডির আর্থিক সহায়তায় ‘সিকিউরিং ওয়াটার ফর ফুড’ প্রকল্পের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক বাণিজ্যিক মডেল হিসেবে বালুচরে মিষ্টি কুমড়া চাষের পাইলটিং শুরু করে এবং ২০১৫-১৬ সালে ৬০০ জন ভূমিহীন কৃষক ৪০৯৬ টন মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করে, প্রতি কেজি ৮ টাকা দরে যার বাজারমূল্য সোয়া তিন কোটি টাকারও বেশি। চলতি বছরে একই প্রকল্পের আওতায় তারা রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার ২৫০ হেক্টর বালুচরে ৯৯৬ জন ভূমিহীনের মাধ্যমে মিষ্টি কুমড়া চাষ করে। এছাড়া ইউকেএআইডির সহায়তায় পামকিন ‘এ্যাগেইনস্ট পোভার্টি’ প্রকল্পের আওতায় ২০০ হেক্টর বালুচরে মিষ্টি কুমড়া চাষ করে দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৪ হাজার মেট্রিক টন মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করে, যার বাজারমূল্য ১১ কোটি ২০ লাখ টাকা। লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই মিষ্টি কুমড়া চাষীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০০৫ সাল ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার হেক্টর চরের অনাবাদি জমি মিষ্টি কুমড়া চাষের আওতায় এসেছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, বাঁধে আশ্রয় নেয়া ভূমিহীন পরিবারগুলোকে স্বাবলম্বী করতে আমরা কাজ করছি। চরের বালিজমিতে কুমড়া চাষে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, বীজ, সেচ, কীটনাশকের জন্য আর্থিক সহায়তা করছি। প্রতিটি পরিবারের ১০০ গাছ থেকে গড়ে পাঁচ শতাধিক কুমড়া উৎপাদিত হয়েছে। তাদের ২০০ কুমড়া রাখার মাচা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এতে বিক্রির পর তারা অবশিষ্ট কুমড়া সংরক্ষণ করে আপৎকালে সংসার চালাতে পারবে। তিনি বলেন, এর চাষ পদ্ধতি অতিসহজ এবং উৎপাদন খরচ খুবই কম। চরে গর্ত করে তাতে কম্পোস্ট সার দিয়ে এ কুমড়া উৎপাদন করা যায়। গর্তে পলিথিন দিয়ে পানি সংরক্ষণ করে ওই পানি সেচকাজে ব্যবহার করা যায়। মিষ্টি কুমড়া খরা সহনশীল বলে খুব বেশি সেচের প্রয়োজন হয় না। অক্টোবর-নবেম্বরে যখন চরগুলো জেগে ওঠে তখন কুমড়ার বীজ লাগানো হয়। মার্চ-এপ্রিলে চরে পানি ওঠার আগেই ফসল ঘরে তোলা যায়। ফলে বন্যার পানিতে ফসলের ক্ষতি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ভূমিহীন চাষী আব্দুল খালেক জানান, তার নিজের জমি নেই। অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন। গত বছর তিনি চরের পতিত জমিতে ৪০০টি গাছ লাগান। এতে তার মোট খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি কুমড়া বিক্রি করেছেন ৪০ হাজার টাকা। এ বছর তিনি ৬শ’টি গাছ লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, এখন নিজের জমিতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে নিজে কাজ করি। ফলে অন্যের মজুরি করতে হয় না। মিষ্টি কুমড়া চাষ করে এখন তার সংসারের অভাব অনেকটা দূর হয়েছে। তার মতো ভূমিহীন দেলওয়ার, গণেশ, নরেন, সুকুমার এবং মহব্বতও একই কথা জানান। এ প্রকল্প পরিদর্শনে এসে শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য চাহিদা বাড়ছে। পাশাপাশি কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য জমি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। সেক্ষেত্রে সারাদেশের চর এলাকার লাখ লাখ হেক্টর পতিত জমি চাষের আওতায় আনতে পারা একটি উত্তম বিকল্প হতে পারে। চরের বালুকাময় জমিতে যে মিষ্টি কুমড়া চাষ করা সম্ভব তা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ভূমিহীন চাষীরা যেমন বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাবে, তেমনি তাদের পুষ্টির চাহিদাও মিটবে। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে আরও তৎপর হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, দেশে সবগুলো চরে কুমড়া চাষ করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা যাবে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এর ব্যাপক চাহিদা আছে। তাছাড়া চাষীরা যাতে উৎপাদিত মিষ্টি কুমড়া ভাল দামে বিক্রি করতে পারে সেজন্য এর বহুমুখী ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেনÑ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল হক বেগ, অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. হামিদুজ্জামান আকন্দ ও প্রাকটিক্যাল এ্যাকশনের ব্যবস্থাপক কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান।
×