ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ

রেলের তিন কাজের ব্যয় বাড়ানো নিয়ে আবার আপত্তি ভারতের

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রেলের তিন কাজের ব্যয় বাড়ানো নিয়ে আবার আপত্তি ভারতের

মশিউর রহমান খান ॥ ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাস্তবায়নাধীন বাংলাদেশ রেলওয়ের ২ প্রকল্পের তিনটি কাজের ব্যয় বাড়ানো নিয়ে দ্বিতীয় দফা আপত্তি তুলেছে ভারত। সম্প্রতি প্রকল্প তিনটির বাস্তবায়নের জন্য রেলওয়ের দেয়া দরপত্র সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে দ্বিতীয় দফায় বিস্তারিত জানতে ব্যাখ্যা ও সংশ্লিষ্ট কাগজ চেয়েছে ভারত। এর বিপরীতে ভারতের চাহিদার কাগজের মধ্যে চুক্তি অনুসারে যেসব কাগজ প্রয়োজন ও সরকারী ক্রয় বিধি অনুযায়ী যেসব তথ্য প্রদান করা সম্ভব সম্প্রতি সেগুলো ভারতকে প্রদান করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে, যার উত্তর এখনও প্রদান করেনি ভারত। প্রকল্পগুলোর মধ্যে গত বছরের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় খুলনা টু মংলা পর্যন্ত রেলপথ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্প তিনটির মধ্যে একই প্রকল্পের আওতায় গত বছরের আগস্টে রূপসা রেল সেতু নির্মাণের চুক্তি হয়। তাছাড়া একই বছরের অক্টোবরে খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয়। কিন্তু প্রকল্পের দুটি প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ প্রস্তাব ভারতের এক্সিম ব্যাংকে আটকে আছে। ফলে এসব প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দ কমানোর আবেদন করেছে রেলওয়ে। ভারত যথাসময়ে অনুমোদন না দেয়ায় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন এবং কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অত্যধিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিটি দরপত্র মূল্যায়নের কাগজপত্র চেয়ে পাঠায় ভারতের এক্সিম ব্যাংক। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর জরুরী বৈঠক করেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা। পরে বাংলাদেশ রেলওয়ে ভারতের ওই ব্যাংকটির কাছে চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাঠায়। তবে ব্যাংকটি পাঠানো ব্যাখ্যা যথেষ্ট বলে মনে করেনি বিধায় সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয় ভারতের এক্সিম ব্যাংক। এ সম্পর্কে রেলওয়ের মতে, এক্সিম ব্যাংকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পরিবর্তন হওয়ায় এ ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি কোন সমস্যা মনে করছে না ভারত। উল্লেখ্য, এর আগে এলওসির কোন প্রকল্পেই দরপত্র মূল্যায়নের অনুলিপি চেয়ে পাঠায়নি ভারতের এক্সিম ব্যাংক। রেল সূত্রে জানা গেছে, ভারতের এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন না পাওয়ায় প্রকল্প তিনটির বাস্তবায়নের জন্য চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যাদেশ দিতে পারছে না রেলওয়ে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ আটকে আছে। এছাড়া চুক্তিপত্রের শর্তানুসারে ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে ঠিকাদারের অনুকূলে মোবিলাইজেশন বাবদ চুক্তিমূল্যের ১০ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তাই চলতি অর্থবছরে তিনটি প্রকল্পের বরাদ্দ কমানোর আবেদন করা হয়েছে। ফলে প্রকল্পগুলোর কাজ বন্ধ হয়ে আছে। রেলওয়ের তথ্যমতে, এলওসির আওতায় খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয় গত অক্টোবরে। আর আগস্টে রূপসা রেল সেতু নির্মাণে চুক্তি করা হয়। দুটি প্যাকেজের জন্য ব্যাংকটি ব্যাখ্যা চায় যথাক্রমে নবেম্বর ও সেপ্টেম্বরে। ব্যাখ্যা চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে গত ১০ ডিসেম্বর ভারতের এক্সিম ব্যাংকে জবাব পাঠায়। তবে এ জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এরপর দ্বিতীয় দফা ঠিকাদার নিয়োগের প্যাকেজ দুটির বিভিন্ন ডকুমেন্ট চেয়ে পাঠিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত চিঠি পায় রেলওয়ে। জানা গেছে, শীঘ্রই এর ব্যাখ্যাও পাঠানো হবে। সম্প্রতি রেলওয়েকে পাঠানো এক চিঠিতে এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বলেছে, চুক্তির অনুলিপি দেখে রূপসা রেল সেতু ও খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণে ক্লিয়ারেন্স দেয়া সম্ভব নয়। এজন্য দরপত্র মূল্যায়নের সারসংক্ষেপ পাঠাতে হবে। এছাড়া প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দরপত্র সম্পূর্ণ গোপনীয় বিষয়। অতএব এর মূল্যায়ন ও সংশ্লিষ্ট তথ্যও স্বাভাবিকভাবে গোপন রাখা হয়। মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়া এর সারসংক্ষেপ শুধু আদালত তলব করলেই দেয়া হয়। এর বাইরে সাধারণত দরপত্র মূল্যায়নের অনুলিপি দেয়া সম্ভব নয়। তবে প্রকল্প ক্লিয়ারেন্সের জন্য এখন বাধ্য হয়েই ভারতে এর সারসংক্ষেপ পাঠাতে হবে। রেলসূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৭২১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। তবে গত বছর মে মাসে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা করা হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে গেছে প্রায় ২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা বা ১২৩ শতাংশ। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়ন মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। সম্ভাব্যতা জরিপসহ খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১০ সালে। এ প্রকল্পের অর্থায়নে ২০১১ সালে সম্মতি জানায় ভারত। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ করার কথা থাকলেও সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নক্সা প্রণয়নেই পেরিয়ে যায় চার বছর। গত বছর ডিসেম্বরে রূপসা রেল সেতু ও খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণে পৃথক দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় রূপসা রেল সেতু নির্মাণে ভারতের লারসন এ্যান্ড তুবরো লিমিটেড এবং মূল রেলপথ নির্মাণে ইরকন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। চুক্তিমূল্য যথাক্রমে ১ হাজার ৭৬ কোটি ৪৫ লাখ ও ১ হাজার ১৪৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। রেলওয়ের তথ্যমতে, প্রকল্প ব্যয় বাড়ায় খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণে ভারতের ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটিতে ভারতের ১ হাজার ২০২ কোটি ৩১ লাখ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে তা বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৯৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা করা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে তা অনুমোদনের জন্য ভারতের হাইকমিশনে পাঠানো হয়। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হলেও এখনও সে প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়নি ভারত। এদিকে ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেয়া হয় ২০১২ সালে। সে সময় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৯৫৯ কোটি ২০ লাখ টাকায়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১০৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির সমীক্ষা ও বিস্তারিত নক্সা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ গত বছরের ২ জুন চুক্তি হলেও ঠিকাদার নিয়োগ প্রস্তাবটি এখনও আটকে আছে। অপরদিকে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ সংস্কার প্রকল্পেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। এ প্রকল্পে ২০১৩ সালে ব্যয় ধরা হয় ৫১৬ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত আগস্টে পরামর্শক নিয়োগ চুক্তি করা হয়। ফলে উক্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন আটকে আছে। প্রকল্পটি সম্পর্কিত যথাক্রমে অক্টোবর ও ডিসেম্বরে দুই দফা ব্যাখ্যা পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিও কারণ হিসেবে জানা গেছে, এ্যালাইনমেন্ট পরিবর্তনের ফলে রূপসা নদীতে প্রায় ৭১৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি রেল সেতু নির্মাণ করতে হবে। সেই সঙ্গে রেলপথের দৈর্ঘ্য বেড়েছে ১২ কিলোমিটার। ফলে বাড়ছে জমি অধিগ্রহণও। আর ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ৬০ কেজির রেলপাত ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব কারণে খুলনা-মংলা রেলপথ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর জন্য আপত্তি তোলেনি ভারত। প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানোর সময় ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়াই আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রেললাইনের সীমানা বৃদ্ধি, জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু যৌক্তিক কারণে ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া ভারতের এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন হওয়ায় প্রথমবারের মতো দরপত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় রেলওয়েকে। আমরা এ সংশ্লিষ্ট চাহিদাকৃত সকল তথ্য আলোচনাসাপেক্ষে ভারতে পাঠিয়েছি। এক্সিম ব্যাংক দ্বিতীয় দফায় আরও কিছু তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায়। এর মধ্যে দরপত্র সংশ্লিষ্ট এমন কিছু তথ্য রয়েছে, যা অতি গোপনীয় এগুলো যে কেউ চাইলেও সরকারী নিয়ম অনুযায়ী প্রদান সম্ভব নয়। তাই দ্বিতীয়বার সকল তথ্য যাচাইবাছাই শেষে নতুন করে তাদের চাহিদার জবাব দিয়েছি। প্রকল্প দুটির যথাসময়ে অনুমোদন না হওয়ায় বাস্তবায়ন কাজ আটকে আছে। ফলে এ সংশ্লিষ্ট কোন কাজই করা সম্ভব হচ্ছে না। যার প্রভাব প্রকল্পের ওপর পড়ছে। তবে প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করতে ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করছি। আশা করি তিনটি কাজের মধ্যে চলতি সপ্তাহে ঠিকাদার নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়া যাবে বাকি একটির অনুমোদনও আগামী সপ্তাহে অনুমোদন পাওয়া যাবে। এরপরই আমরা প্রকল্পের কাজ শুরু করব।
×