ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আকর্ষণীয় মূল্যছাড়ের হিড়িক বিক্রির রেকর্ডও ভঙ্গ

জমজমাট বাণিজ্যমেলা ক্রেতা-দর্শনার্থীর বিপুল সমাগম

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

জমজমাট বাণিজ্যমেলা ক্রেতা-দর্শনার্থীর বিপুল সমাগম

রহিম শেখ ॥ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে পুরোপুরি জমজমাট হয়ে উঠেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা। ক্রেতাদের আকর্ষণে দেশী-বিদেশী বাহারি পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় প্রতিটি পণ্যেই আকর্ষণীয় মূল্য ছাড়ের হিড়িক পড়েছে। আর তাতেই সাড়া দিয়ে বাণিজ্যমেলায় আসছেন ক্রেতা-দর্শনার্থীরা। শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় দুপুরের পর থেকেই দর্শনার্থীদের স্রোত ছিল মেলা প্রাঙ্গণের দিকে। বিকেলের দিকে টিকেট কাউন্টারের সামনে ছিল লম্বা লাইন। সেই জনস্রোত সন্ধ্যায় রীতিমতো জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মেলা প্রাঙ্গণ পরিণত হয় জমজমাট উৎসবমুখর পরিবেশে। আগের তুলনায় বিক্রির রেকর্ডও ভেঙ্গেছেন বিক্রেতারা। রাজধানীর শেরেবাংলানগরে শুক্রবার মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, শীতের সকালে সূর্যের আলো ছড়ানোর পরপরই আসতে শুরু করেছেন বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়নের বিক্রয়কর্মীরা। আর সকাল ১০টায় মেলার প্রবেশপথে ছিল ক্রেতা-দর্শনার্থীর ছোট ছোট লাইন। বেলা গড়িয়ে দুপুর হওয়ার আগেই জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। শেষ বিকেলে আগত যারা তাদের প্রায় ঘণ্টাখানেক দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশ টিকেট কাটতে হয়েছে। ক্রেতার বাড়তি চাপে মেলার আশপাশের সড়কেও ছিল বেশ যানজট। আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবন থেকে মেলার প্রবেশপথ পর্যন্ত ছিল ক্রেতা-দর্শনার্থীদের দীর্ঘ লাইন। বিকেলে উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়ে সংশ্লিষ্টদের। এ অবস্থা ছিল রাত ১০টা পর্যন্ত। শুক্রবার মেলায় প্রায় দেড় লাখ ক্রেতা-দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রবেশপথের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান মীর ব্রাদার্সের কর্ণধার মীর শহিদুল আলম। দর্শনার্থীর এ বিপুল সাড়া পেয়ে খুশি মেলার আয়োজকরা। এদিন ক্রেতা বাড়ায়, বিক্রিও বেড়েছে। দিনভর ক্রেতা সামলাতে স্টল মালিকদের ক্লান্তি ঢাকা পড়ে জমজমাট বেচাকেনার কারণে। কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধি জনকণ্ঠকে জানায়, মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে পুরোপুরি জমজমাট হয়ে উঠেছে বাণিজ্যমেলা। যাঁরা এখন মেলায় আসছেন, সবাই কিছু না কিছু পণ্য কিনছেন। এদিকে মেলায় কেনাকাটার পাশাপাশি বিনোদন পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেক ক্রেতা। আলাপকালে রাজধানীর মিরপুর থেকে আসা সুলতানা ইয়াসমিন জনকণ্ঠকে জানান, মেলা থেকে ঘর-সংসারের জন্য কিছু তৈজসপত্র ও ছেলের জন্য একটি সাইকেল কিনেছি। কেনাকাটায় এখানে সুবিধা হিসেবে পেয়েছি মূল্যছাড়। এছাড়া এ শহরে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর তেমন একটা জায়গা নেই। এ সুযোগে ওরা কিছুটা বিনোদন পেয়েছে। সব মিলিয়ে এক ছাদের নিচে অনেক পণ্য পাওয়ার সুবিধা আছে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, বাণিজ্যমেলায় আসছে ঢাকার বাইরের ক্রেতা-দর্শনার্থীও। তাদেরই একজন গাজীপুর থেকে আসা আরিফুল ইসলাম। স্ত্রীসহ মেলায় আসা এ ক্রেতা জানালেন, এখানে অনেক দেখেশুনে, মনের মতো পণ্য কেনার সুযোগ আছে। অধিকাংশ স্টল ও প্যাভিলিয়নে নগদ অঙ্কের ছাড়, নানা ধরনের উপহার, স্ক্র্যাচকার্ডে পণ্য জিতে নেয়ার সুযোগ, প্যাকেজ অফারে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা ছাড় দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের কেনাকাটা বেড়েছে। মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে আরও দেখা মেলে বড় বড় প্যাভিলিয়নে দেশীয় পণ্যের পসরা। অতীতের তুলনায় এবার মেলায় দেশী পণ্য বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। কী নেই মেলায়? এমন প্রশ্ন জেগে উঠতেই পারে অনেকের মনে। হয়ত তারও উত্তর মিলবে সাধ ও সাধ্যের মধ্যে। এবারের মেলায় প্রধান প্রধান পণ্য তালিকায় আছে কসমেটিক, ইলেকট্রিক্যাল, পাটজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, স্পোর্টস গুডস, মেশিনারিজ, কার্পেট, জুয়েলারি, জুতা, কাপড় সামগ্রী ইত্যাদি। সব মিলিয়ে ছোট-বড় সবার প্রয়োজনীয় পণ্যের কোন কমতি নেই। পাশাপাশি রয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য নাগরদোলা। শুক্রবার বাণিজ্যমেলার প্লাস্টিক পণ্যের স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ক্রেতা দেখা গেছে। বেঙ্গল, আরএফএল, এনপলি, তানিন, গাজীসহ বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যের স্টলে সারাদিনই ভিড় লেগেছিল। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাণিজ্যমেলায় প্লাস্টিকের বাটি, মগ, জগ, চেয়ার, টেবিল, টুল ও বাচ্চাদের তৈরি খেলনা সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। মেলায় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও বিভিন্ন দোকানে অন্য পণ্যের পাশাপাশি প্লাস্টিকের মগ, জগ, থালাবাটি, পানির পাত্র বিক্রি হচ্ছে। এসব দোকানে মূল্যছাড় দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা চলছে। এবার মেলায় গৃহস্থালি পণ্য বিক্রি হয়েছে সর্বাধিক। দিল্লী ও কিয়াম এ্যালুমিনিয়ামসহ কয়েকটি স্টলে ক্রেসার ঠাসা ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। অন্য বছরের চেয়ে এবার এ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের আধিক্য সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বাণিজ্যমেলায় অন্য সব পণ্যের তুলনায় ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদাও বেশ। শুক্রবার ওয়ালটন, রানার, যমুনা, সনিসহ বিভিন্ন নামীদামী প্যাভিলিয়নে সারাদিনই ভিড় লেগেছিল। এদিকে দেশী-বিদেশী ফ্রিজ ও রেফ্রিজারেটরেও ছিল ক্রেতাদের আকর্ষণ। দেশীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন, যমুনা, ভিশন ছাড়াও বিদেশী ব্র্যান্ড শার্প, সিমেন্স, সিঙ্গার, গোদরেজ, র‌্যাংগস, এলজি ফ্রিজের প্যাভিলিয়নের ক্রেতা দর্শকদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। তবে বিদেশী পণ্যের চেয়ে দেশী পণ্যের দাম তুলনামূলক কম এবং মানেও ভাল হওয়ায় সেদিকেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন তারা। এক্ষেত্রে ওয়ালটন ফ্রিজই এগিয়ে রয়েছে বলেই সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে। বিদেশী ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ওয়ালটনও তৈরি করেছে নন-ফ্রস্ট ফ্রিজ। তবে এসব ফ্রিজ এখনও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে না। আয়োজকরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গণ সবার জন্য উন্মুক্ত। তিনটি প্রবেশপথ দিয়ে মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন দর্শনার্থীরা। তবে একটি প্রবেশপথ শুধু ভিআইপি দর্শনার্থীর জন্য সংরক্ষিত। মেলায় প্রবেশে জনপ্রতি টিকিটের মূল্য ৩০ টাকা। শিশুদের ২০ টাকা। যেসব শিশুর বয়স দুই বছরের কম, তাদের জন্য কোন প্রবেশ টিকিটের প্রয়োজন হবে না। ইপিবি জানিয়েছে, এবারের বাণিজ্যমেলায় ১৩টি ক্যাটাগরিতে মোট ৫৫৩টি স্টল আর ৯৪টি প্যাভিলিয়নে বাংলাদেশসহ ২১টি দেশের নামীদামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, মরিশাস, ঘানা, নেপাল, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মেলায় দেশীয় নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে ৩৮টি স্টলে। আর নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করতে প্রতি বছরের মতো এবারও আছে বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়ন। আছে দুটি মা ও শিশু কেন্দ্র এবং একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র। মসজিদ, এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, প্রতিবন্ধীদের জন্য আছে অটিজম সেন্টার, শিশুপার্ক, ইকোপার্ক, ই-শপ, ই-পার্ক ও পর্যাপ্ত টয়লেট। মেলা প্রাঙ্গণে ২৫টি খাবার স্টল ও ৫টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এ ছাড়াও আছে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আয়োজকদের তথ্যমতে, এবার মেলার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ জন্য আছেন বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য। যে কোন ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড। এ ছাড়াও মেলা প্রাঙ্গণ ও আশপাশ এলাকার নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১০০ সিসি ক্যামেরা।
×