মনের ইচ্ছামতো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে কার না ভাল লাগে? তবে সেই সময় ও সুযোগ সবাই পায় না অথবা হয় না। তবে আগ্রহ ও কৌতূহলটা অনেকের মনেই রয়ে যায়। আর সেই চাহিদা পূরণে ভ্রমণ কাহিনী বা ভ্রমণ সাহিত্যের আশ্রয় নেন কেউ কেউ। বিশেষ করে ঘুরে বেড়ানোর মানসিকতার সঙ্গে যদি থাকে পাঠাভ্যাস। সেই সব পাঠকদের জন্য এবারের একুশের বইমেলায় বেরিয়েছে অর্ধশতাধিক ভ্রমণগ্রন্থ। সেসব বইয়ের প্রতি রয়েছে ভ্রমণপিপাসু পাঠকের বিশেষ নজর। এসব ভ্রমণ কাহিনীর পাতায় চোখ বুলিয়ে ঘটে যায় পাঠকের মানস ভ্রমণ। তাই অচেনা স্থান ও তার ইতিহাস কিংবা সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনধারা জানার টানে মেলায় চলছে ভ্রমণ গ্রন্থের বিকিকিনি।
সোমবার বসন্ত বিকেলে মেলার দুই আঙিনার এক ক্যানভাস সোহ্রাদওয়ার্দী উদ্যানে দেখা মেলে ভ্রমণপ্রিয় এক পাঠকের। জাগৃতি প্রকাশনীর স্টলের সামনে কথা হয় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্ময় হাসানের সঙ্গে। কথা শুরুর একটু আগেই এই পাঠক স্টলটি থেকে কিনেছেন আনিসুল হকের ভ্রমণকাহিনী ‘রহস্যের নাম ব্রাজিল’। বইটি সংগ্রহের হেতু জানতে চাইলে বলেন, এবারের বিশ্বকাপটা হয়েছে ব্রাজিলে। ফুটবলের সমৃদ্ধ এতিহ্য আর সাম্বা নাচের এই দেশটি আমাকে দারুণ টানে। ফুটবলের শৈল্পিকতা ধারণকারী এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় ব্রাজিলের যাপিত জীবনের প্রতিও রয়েছে অপার আগ্রহ। আর এসব চাহিদা মেটানোর চিন্তা থেকেই কিনে ফেললাম বইটা। তার ওপর আবার আমার প্রিয় লেখকদের একজন আনিসুল হক।
এবারের মেলায় উৎস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে দুইটি ভ্রমণগ্রন্থ। শাকুর মজিদের ‘অন্নপূর্ণায়’ ও মোস্তাফা সেলিমের ‘ভারত নেপাল ভুটান ভ্রমণসঙ্গী’। দুটি বইই বেশ পাঠক টানছে উল্লেখ করে এই প্রকাশনীর প্রকাশক ও লেখক মোস্তফা সেলিম বলেন, দেশে এখন ভ্রমণ সাহিত্যের পাঠক তৈরি হয়েছে। দশ বছর আগেও এমনটা ছিল না। তাই এখন মেলায় অসংখ্য ভ্রমণের বই বের হয়। আর সেসব পড়ে পাঠকেরও অজানা কোন পরিবেশ-প্রকৃতি কিংবা সেই অঞ্চলের যাপিত জীবনের বিষয়ে মানসভ্রমণ হয়ে যায়।
চলমান সময়ের ভ্রমণ সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক শাকুর মজিদ বলেন, ভ্রমণ কাহিনীর পাঠকের পাশাপাশি লেখকও বেড়েছে। একজন মানুষের পক্ষে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়। অনেক সময় নিজ দেশের বেলায়ও তেমনটা ঘটে থাকে। সেক্ষেত্রে ভ্রমণকাহিনীর মাধ্যমে অন্যের চোখ দিয়ে দেখা ও মনের আনন্দ মেটানোর সুযোগ পায় পাঠক। তবে এখন ভ্রমণবিষয়ক অসংখ্য বই বেরুলেও অনেক ক্ষেত্রে লেখকের শ্রমের ঘাটতি দেখা যায়। পরিপূর্ণভাবে একটি অঞ্চল ও সেখানকার পরিবেশ-প্রকৃতি কিংবা জনগোষ্ঠীর জীবনের বিবরণ উঠে আসে না বইয়ে। কিছু ছবির সঙ্গে সামান্য বিবরণ দিয়ে দায়সারাভাবে প্রকাশিত হয় এসব ভ্রমণগ্রন্থ।
নির্বাচিত ভ্রমণগ্রন্থ ॥ বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য এবং সরেজমিনে মেলা ঘুরে জানা গেছে, এবার মেলায় প্রকাশিত হয়েছে অর্ধশতাধিক ভ্রমণসাহিত্য। এর মধ্যে বেশ কিছু ভ্রমণকাহিনীর প্রতি রয়েছে পাঠকের বিশেষ কৌতূহল। এসব ভ্রমণ বইয়ের মধ্যে অবসর থেকে এসেছে শাকুর মজিদের ‘প্রাগের ঠাকুরোভা লবণপুরের মোজার্ট’ এবং উৎস থেকে ‘অন্নপূর্ণায়’। সময় প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের দ্বিতীয় খ-ের ‘ওড়াউড়ির দিন’। চারুলিপি থেকে এসেছে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ‘তিন সমুদ্রের দেশে’। প্রথমা থেকে প্রকাশিত হয়েছে মঈনুস সুলতানের ‘সোয়াজিল্যান্ড রাজা প্রজা পর্যটক’। বাংলাপ্রকাশ থেকে এসেছে হুমায়ূন কবীর ঢালীর ‘বাঙালের আমেরিকা দর্শন’। জাগৃতি থেকে এসেছে আনিসুল হকের ‘রহস্যের নাম ব্রাজিল’ ও সেগুফতা ইয়াসমিনের ‘ভালো থেকো কাশ্মীর’। অ্যার্ডন থেকে এসেছে হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘ইতালিয়া’ ও শাহেদ আলীর ‘অন্যরকম আমেরিকা’ এবং নাদিম কাদিরের ‘মাই বিউটিফুল বাংলাদেশ’। আগামী থেকে এসেছে প্রশান্ত লাহিড়ীর ‘পৃথিবীর একঝলক’। ঐতিহ্য থেকে বেরিয়েছে আশিকুর রহমানের ‘জাপান কাহিনী’। অনিন্দ্য এনেছে লিয়াকত হোসেন খোকনের ‘বাংলাদেশ নদ নদী ভ্রমণ’। জয়তী থেকে এসেছে ড. চিত্তরঞ্জন দাসের ‘দেশ দেশান্তর (২য় খ-)’। মুক্তচিন্তা প্রকাশনী থেকে এসেছে তারেক অণুর ‘পথ চলাতেই আনন্দ’। উৎস থেকে এসেছে মোস্তফা সেলিমের ‘ভারত নেপাল ভুটান ভ্রমণসঙ্গী’। পালক থেকে বেরিয়েছে ব্রিগেডিয়ার জে. এম সাখাওয়াত হোসেনের ‘টিপু সুলতানের দেশে’ ও ‘প্যারিস থেকে ভিয়েনা’। মূর্ধন্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে সঞ্চিতার ‘রাইং খ্যাং-এর কান্না হাসি’।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বিশেষ স্টল ॥ ভ্রমণ সাহিত্যের বাইরে ভ্রমণবিষয়ে জানতে মেলায় রয়েছে একটি আলাদা স্টল। মেলার বাংলা একাডেমি অংশের ৫১৫নং বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের স্টলের মাধ্যমে ভ্রমণপিপাসুরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করলে কী কী দেখতে পাবেন সেই নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে।
কাওসার রহমানের চার বই ॥ সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক কাওয়ার রহমানের চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবারের গ্রন্থমেলায়। ধ্রুব এষের প্রচ্ছদে অনিন্দ্য প্রকাশ বেরিয়েছে ‘ও আমার মেঘ বালিকা’। পালক পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘কালো টাকার সন্ধানে’ ও ‘ফিড দ্য ফিউচার : বাংলাদেশ ইন ফোকাস’। কালান্তর প্রকাশনী থেকে এসেছে শিশুতোষ বই ‘শ্মশান ঘাটের ভূত’।
সোমবারের মেলা চিত্র ॥ একুশের গ্রন্থমেলা এখন যেন ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। কমে গেছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। বেড়েছে পাঠকের আগমন। ফলে মেলার দুই আঙিনাতে বরাজ করেছে জমজমাট ভাব। এখন আর দেখাদেখি নয়, বই কেনায় মনোযোগী হয়েছেন পাঠকরা। সোমবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি মেলার দুই অংশেই সেই দৃশ্যের দেখা মিলেছে।
নজরুল মঞ্চের চিত্র ॥ সোমবার মেলার ২৩তম দিনে একাডেমির নজরুল মঞ্চে ১১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। এর মধ্যে আবু হানিফ হৃদয়ের ‘বউকে ভালোবাসিও বিশ্বাস করিও না’ শীর্ষক উপন্যাসগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আকাশ প্রকাশনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর শিকদারের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিবৃন্দ। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রমুখ।
নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যানুযায়ী সোমবার মেলার ২৩তম দিনে নতুন বই এসেছে ৯৯টি। এর মধ্যে গল্প ১৪টি, উপন্যাস ১৭, প্রবন্ধ ৪, কবিতা ৩৪, গবেষণা ৪, ছড়া ১, শিশুসাহিত্য ১, জীবনী ৫, নাটক ২, বিজ্ঞান ১, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ৩, রম্য/ধাঁধা ১, সায়েন্স ফিকশন ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর নতুন বই এসেছে ৯টি। এছাড়া সব মিলিয়ে ২৩তম দিন পর্যন্ত মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৫২টি বই।
নির্বাচিত বই ॥ ফরিদুর রেজা সাগরের ‘রাতুল মামা ফিল্ম স্টার’ এনেছে চন্দ্রাবতী একাডেমি, রাজিব আহমেদের ‘মীরাক্কেল জোকস’ এনেছে কালিকলম প্রকাশন, শামীমা সুনির ‘নাভির নাব্যতা’ এনেছে উৎস প্রকাশন, ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর ‘জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র’ ও শাহজাহান চৌধুরীর ‘ব্রিকলেন’ এনেছে জাগৃতি, আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘সংস্কৃতি’, ড. মিজানুর রহমানের ‘লিটল ম্যাগাজিন’ এনেছে ভাষাপ্রকাশ, ড. মোহাম্মদ আমীনের ‘অফিস আদালতে বাংলা লেখার নিয়ম’, সালেহ মাহমুদ রিয়াদের ‘বাংলা ভাষা’ এনেছে মাওলা ব্রাদার্স, আখতার হুসেনের ‘জনকের মুখ’, রহমান শেলীর ‘আমি এ্যালিয়েন’ এনেছে কথাপ্রকাশ, অনল রায়হানের ‘হঠাৎ বাবার পঁচিশ পাতায়’ এনেছে অনুপম, ফরিদুর রেজা সাগরের ‘দেয়ালের লিখন’ প্রকাশ করেছে শিশু রাজ্য প্রকাশন।
মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ সোমবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সবুজপত্রের শতবর্ষ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. ইসরাইল খান ও আবদুল আলীম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাভাষা ও সাহিত্যসেবীদের মধ্যে প্রবন্ধপ্রধান লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের যে উৎসাহ আজ অবধি দেখা যায় তার উৎস প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র। তবে বাঙালী মানসের যে দৈন্য ও সনাতন গ-ির জন্যে প্রমথ চৌধুরী সবসময় আফসোস করেছেন এবং এই সুপ্তিমগ্ন মানসকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে যে সবুজপত্র প্রকাশ করেছিলেন তার প্রয়োজন যেন আজও ফুরিয়ে যায়নি। বরং এ যেন সুপ্তি থেকে জেগে নতুনতর নানান মোহে আচ্ছন্ন মানস। একে কেবল ধাক্কা দিয়ে জাগালেই হবে না, ক্রমাগত নিরবচ্ছিন্নভাবে জাগিয়ে রাখার কাজ কাউকে না কাউকে করতেই হবে। ধাক্কা দেয়ার উপযুক্ত বাহন তাই এখনও চাই। ফলে না সবুজপত্র না এর সারথী প্রমথ চৌধুরী কারুরই প্রয়োজন আজও ফুরায়নি।
সভাপতির বক্তব্যে গোলাম মুরশিদ বলেন, সবুজপত্র সম্পাদনা ও প্রকাশে প্রমথ চৌধুরীর নেতৃত্বে তৎকালীন তারুণ্যের ভূমিকা প্রধান হলেও এর নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদানও অসামান্য। রবীন্দ্রনাথ সব সময় নতুনরূপী বসন্তের গুণগ্রাহী ছিলেন তাই সবুজপত্র-এ চিন্তা ও ভাষার নবীনতা তাঁকে আকর্ষণ করেছিল।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল নবীন কিশোরের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরামের পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, শফি ম-ল, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, পাগলা বাবলু, ডালিয়া সুলতানা, আজগর আলীম, বিশ্বজিৎ রায়, শ্যামল কুমার পাল, রুশিয়া খানম, সাগর বাউল প্রমুখ।
আজকের অনুষ্ঠান ॥ আজ মঙ্গলবার বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলাদেশের লোকজ-সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক মাহবুবুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন অসীমানন্দ গঙ্গোপাধ্যায়, গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া, মুহম্মদ শহীদ উজ জামান, মির্জা তাসলিমা সুলতানা ও মাহবুবা নাসরীন। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস।