এক.
তাঁকে দেখলে চোখ ফিরিয়ে রাখা দায়। যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক যুবরাজ। সাধারণ বাঙালীর চেয়ে বেশ দীর্ঘ। ছিমছাম গড়ন। পাকা গমের মতো গায়ের রং। আর কী লাল! চামড়ার নিচ দিয়ে প্রবহমান রক্তও বুঝি দেখা যায়। টিকলো নাক। নীল বর্ণ চক্ষু। পায়ে চামড়ার কাজ করা স্যান্ডেল। পরিপাটি চুল। বেশভূষাও তা-ই। ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবিতে তাঁকে মুহূর্তে দশজনের চেয়ে আলাদা করা যায়। শুদ্ধ বাংলায় উচ্চারণ। যখন কথা বলতেন তখন মনে হতো কথাগুলো তিনি গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন। তাঁর কথার মধ্যে এক ধরনের মুগ্ধতা ছিল। মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আর মুগ্ধতা তৈরি করার এক ঐশ্বরিক গুণ ছিল তাঁর।
এখ্্লাসউদ্দিন আহ্্মদÑ সবার প্রিয় এখ্্লাস ভাই গত বুধবার ভোরে শিশুসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বসবাস ছেড়ে চলে গেলেন অন্য এক জগতে। বয়স হয়েছিল চুয়াত্তর। অনেক দিন ধরেই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। ঘর থেকে খুব একটা বের হতেন না। বেশির ভাগ সময় কাটত মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের বাড়িতে। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের কারণে এক মাস ধরে হাসপাতালে ছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত পাঁচ দিন ধরে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল।
দুই.
‘টাপুর টুপুর’।
ষাটের দশকে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি অসাধারণ পত্রিকার নাম। রঙে, রেখায়, লেখায় আর উৎকর্ষতায় চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রচলিত শিশুসাহিত্যের ধ্যান-ধারণা ও ভাবনাচিন্তায় আধুনিক রুচি, মননের জানান দিয়েছিল টাপুর টুপুর। টাপুর-টুপুরের আত্মপ্রকাশ সে সময় শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল এ কথা যেমন সত্য, ঠিক একইভাবে এটা বলা অসঙ্গত হবে না যে, এর প্রভাব পরবর্তী স্বাধীন দেশের শিশুসাহিত্যের বিকাশ ও এর গতি-প্রকৃতিকে করে তুলেছিল মৃত্তিকাসংলগ্ন। আমাদের শিশুসাহিত্যের অগ্রযাত্রায় টাপুর-টুপুরের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে আছে। টাপুর-টুপুর-এর সম্পাদক ছিলেন শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার এখ্্লাসউদ্দিন আহ্্মদ। তাঁর অনন্য সম্পাদনায় এ পত্রিকায় বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন শিশুসাহিত্যিকরা। শিশুসাহিত্যের আবহমান ধারার সঙ্গে সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ সাহসিকতার সঙ্গে তিনি টাপুর-টুপুর-এ তুলে ধরেছিলেন, যা সেই সময়ের জন্য দুঃসাহসিক কাজও বটে। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, টাপুর-টুপুরকে কেন্দ্র করে দেশের শিশুসাহিত্য পেয়েছে নতুন এক মাত্রা। নতুন উচ্চতা।
তিন.
এখ্্লাসউদ্দিন আহ্্মদ সময়ের সাহসী মানুষ ছিলেন। প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় ছিলেন অগ্রণী। শিশুসাহিত্যের নিবেদিতপ্রাণ এখলাসউদ্দিন আহমদ দু’হাতে লিখেছেন। শিশুসাহিত্যে আধুনিকতার পরশ দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন এই জগতকে। ছড়ার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য মনমাতানো গল্প-উপন্যাস লিখে নিজের বহুমাত্রিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। রূপকথাতেও তিনি তাঁর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘মাঠ পারের গল্প’ তাঁর অন্যতম সেরা কিশোর উপন্যাস। সমালোচকরা ‘মাঠ পারের গল্প’কে বাংলা শিশুসাহিত্যের এক অনন্য সংযোজন বলে মনে করেন। তাঁর লেখায় সমাজের সঙ্গতি-অসঙ্গতি ফুটে উঠেছে তীব্রভাবে। সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল অন্যদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ। তাঁর লেখায় ছিল প্রতিবাদের ঝড়। এ কথার প্রমাণ মেলে ‘বাংলাদেশের ছড়ায় গণচেতনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে। সেখানে বিশ্বজিৎ ঘোষ যথার্থই বলেছেন, ‘পাকিস্তান আমলে যেমন, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের ছড়াকাররা প্রতিবাদে মুখর, দ্রোহিতায় শাণিত। ঔপনিবেশিক শাসক আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এমন কিছু পঙ্ক্তি রচিত হয় এখ্্লাসউদ্দিন আহ্্মদের হাতে।’ স্বৈরাচারের দুঃসহ সেই সময়ে এখলাসউদ্দিন আহমদ লিখছেনÑ ‘হরতালÑ/আজ হরতাল/পেটা ঢাক-ঢোল/ছুড় সড়কি/আন বল্লম/ধর গাঁইতি/ধর বর্শা/দাও হাতে হাত/এই কাঁধে কাঁধ/তোল ব্যারিকেড/গড়ো প্রতিরোধ/কালো দস্যির/ভাঙো বিষদাঁত/ধরো হাতিয়ার/করো গতিরোধ/...খোল করতাল/আজ হরতাল।’
ষাট দশকের শিশুসাহিত্যের নেতৃত্বের পুরো ভাগে ছিলেন তিনি। আফলাতুন, রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই, হাবীবুর রহমান, আতোয়ার রহমান, হালিমা খাতুন, সরদার জয়েনউদদীনসহ আরও অনেকেই ছিলেন। এরপর প্রজন্মের হাত ধরে শিশুসাহিত্য অতিক্রম করেছে বিস্তীর্ণ পথ।
পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন। জনকণ্ঠের শুরু থেকে তিনি যুক্ত ছিলেন ফিচার সম্পাদক হিসেবে। এখানেও ছোটদের সাহিত্য পাতা ‘ঝিলিমিলি’ তাঁর হাত ধরে হয়ে উঠেছিল দেশের অনন্য এক পাতায়। ছোটদের জন্য লিখতে হলে এর জন্য আলাদা একটা ভালবাসা, আলাদা একটা মমতা থাকতে হয়Ñ শিখিয়েছিলেন আমাদের। পরিমিত গদ্যে ফলটা অনায়াসে লেখা যায় সেই শিক্ষাও দিয়েছেন নবীন লেখকদের। এখ্্লাসউদ্দিন আহ্্মদ স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ এক শিশুসাহিত্যের।
শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ যুব উৎসব পুরস্কার, ১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে শিশু একাডেমি পুরস্কার, ২০০৪ সালে কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার, ২০০৭ সালে ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার ও ২০০০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছেÑ এক যে ছিল নেংটি, হঠাৎ রাজার খামখেয়ালি, কাটুম কুটুম, ছোট্ট রঙিন পাখি, বংকুবাবু এবং মামদোর গপ্পো, তনু ও তপু সিরিজের কয়েক ডজন বই। তাঁর লেখা চরিত্রগুলো এখনও শিশু-কিশোরদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তুনু, তপু ও কেঁদোÑ তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্র।
চার.
বেশ কিছুদিন ধরে এখ্্লাসউদ্দিন আহ্্মদ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। শিশুসাহিত্য নিয়ে তাঁর একান্ত ভাবনা-চিন্তা ছিল। অনেক কিছুর সাক্ষীও ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকবার জানিয়েও ছিলেন- এ সব লিখবেন তিনি। বছরখানেক আগে দেখা হলে কথা প্রসঙ্গে এখ্লাস ভাইকে বলেছিলাম সেই কথা। উত্তরে বলেছিলেন, সব গুছিয়ে এনেছি; সময় করে লিখে ফেলব। এখলাস ভাইয়ের সেই সময় আর হয়নি। তিনি চলে গেলেন মাঠ পারের গল্পের ভুবনে। এখলাসউদ্দিন আহমদের এই চলে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁর আরও একটি বিখ্যাত বইয়ের নাম- ‘হঠাৎ রাজার খামখেয়ালি’।