
তারুণ্যে (ডানে) ও সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক তারকা গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন
বাংলাদেশের কিংবদন্তি গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন চার মাস নিখোঁজ। গত ২৬ আগস্ট রাজধানী ঢাকার মগবাজারের বাসা থেকে বের হওয়ার পর আর ফিরে আসেননি সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক। বর্তমানে মহসিন কোথায়, কি অবস্থায় আছেন তা জানেন না পরিবারসহ ক্রীড়াঙ্গনের কেউ। কিংবদন্তির এমন অবস্থায় নিজেদের কষ্টের কথা জানিয়েছেন সাবেক তারকা ফুটবলাররা।
১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল রেলওয়ে ব্লুজের হয়ে খেলেন। ওই বছরেই আন্তঃজুট মিল টুর্নামেন্টে বাওয়া জুট মিলের পক্ষে খেলেন। আশরাফ উদ্দিন চুন্নু ছিলেন ওই দলের খেলোয়াড়। তার দল বাওয়া জুট মিল ফাইনালে উঠে। সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল আদমজী জুট মিল। আদমজীতে তখন সহিদুর রহমান সান্টু ও দেওয়ান আরেফিন টুটুলসহ জাতীয় দলের ৪/৫ জন খেলোয়াড় ছিলেন। ওই ম্যাচে চুন্নুর করা দুই গোলে জয় পেয়ে ফাইনালে উঠে বাওয়া জুট মিল। ফাইনালে খেলা হয়নি তার।
গোলবারে ছিলেন মোতালেব। দুর্ভাগ্যবশত তার দল হেরে যায় আদমজীর কাছে। তবে পুরো টুর্নামেন্টে তার খেলা মনে ধরেছিল চুন্নুর। আঁচ করতে পেরেছিলেন সে একদিন সমর্থকদের মনে জয়গা করে নিবে। যার কথা বলছি নাম তার মোহাম্মদ মহসিন। বাংলাদেশ ফুটবলের গোলবারের নিচে এক বিশ্বস্ত নাম।
১৯৭৯ সালে চুন্নুর মাধ্যমেই যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। ১৯৭৯-১৯৮১ সাল পর্যন্ত আবাহনী হয়ে থাকলেও মাঠে নামা খুব একটা হয়নি। সুহাস তখন আবাহনীর নিয়মিত গোলরক্ষক। ওই সময়ে একজন খেলোয়াড় দুইটা লীগে খেলতে পারতেন। সুহাস চিটাগং লীগ খেলে আহত হলে মহসিনে মাঠে নামার সুযোগ হয়ে যায়। সে বছর লীগ সুপার লীগ মিলিয়ে ৫/৬ টা ম্যাচে নামার সৌভাগ্য হয়েছিল মহসিনের। বলে রাখা ভালো মহসিন যে কটা ম্যাচে খেলেছিল তাঁকে একটি গোলও হজম করতে হয়নি।
১৯৮২ সালে মহসিন আমন্ত্রণ পান ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলার জন্য। লাল মোহাম্মদ তখন মোহামেডানের নিয়মিত গোলরক্ষক। ১৯৮২ সালের ফেডারেশন কাপে পুরো টুর্নামেন্টে খেলেছেন মহসিন। মহসিনকে পরাজিত করে কোনো গোল পুরো টুর্নামেন্টে কেউ করতে পারেনি। লীগে নিয়মিত খেলেছেন লাল মোহাম্মদ। আকস্মিকভাবে মোহামেডান ২-০ গোলে হেরে যায় ভিক্টোরিয়ার কাছে। সমর্থকদের চাপ সহ্য করতে না পেরে ক্লাব ছেড়ে রাতেই চলে যান লাল মোহাম্মদ। আর ফিরে আসেননি।
সেই থেকে সুযোগ হয়ে যায় মহসিনের। এরপর সালাহউদ্দিনের পেনাল্টি কিক ফিরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে যাওয়া মহসিনকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত মোহামেডানের হয়ে খেলে আবারও ফিরে যান আবাহনীতে। ১৯৮৭-১৯৯৩ পর্যন্ত আবাহনীতে খেলে ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধায় যোগ দেন মহসিন।
ফুটবল থেকে অবসরের পর তিনি কানাডায় লম্বা সময় প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। ২০১৪ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে নেশাগ্রস্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এক সময় মহসিনের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তবে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েকবার পালিয়ে যান। বাংলাদেশ জাতীয় দল ছাড়াও মহসিন ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা আবাহনীর হয়ে লম্বা সময় খেলেছেন।
বাংলাদেশ ফুটবলে সোনালী দিনের তারকা গোলরক্ষক মহসিন। খেলা ছাড়ার পর কানাডায় প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে ঢাকায় বসবাস করছেন ২০১৪ সাল থেকে। বয়স ৬১ বছর হলেও শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা গোলরক্ষকের আলোচনায় সান্টু-মহসিন-আমিনুলের নাম প্রায় সমানভাবে উচ্চারিত হয়। গোলের খেলা ফুটবলে গোলরক্ষক হয়েও আশি নব্বইয়ের দশকে অনেক বড় তারকা ছিলেন মহসিন। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক মহসিনের ১৯৮২ এশিয়ান গেমস থেকে উত্থান।
এরপর প্রায় এক যুগ বাংলাদেশ দলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন তিনি। জাতীয় দলের পাশাপাশি দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাব আবাহনী ও মোহামেডানেও খেলেছেন দীর্ঘদিন। দুই বড় ক্লাবের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রেরও অধিনায়কত্ব করেছেন মহসিন। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও বড় তিন ক্লাবে অধিনায়কত্বের গৌরবের বিষয়টি তিনি স্মরণ করতে পারতেন।
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক অনেকদিন থেকে নিখোঁজ। সাবেক কিংবদন্তির এমন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারছেন না ক্রীড়াঙ্গনের মানুষেরা। এ বিষয়ে ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাবেক ফুটবলার মাহমুদুল হক লিটন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর আমার দেখা কিংবদন্তি গোলরক্ষক মহসিন। কোনো অবস্থাতেই তার হারিয়ে যাওয়া আমরা মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। এরকম একজন স্বনামধন্য গোলরক্ষক এত অবহেলার স্বীকার হবে আমরা তা মানতে পারছি না।
মাননীয় ক্রীড়া উপদেষ্টাকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক ফুটবলার রণজিৎ সাহা বলেন, ‘মহসিন ভাইয়ের সঙ্গে আমি অনেকদিন খেলেছি। তিনি খুব ভালো মানুষ। হাসি ছাড়া কথা বলতেন না। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। নতুন খেলোয়াড়দের খুব সাহস জোগাতেন। তিনি এভাবে হারিয়ে যাবেন বিশ্বাস করতে পারছি না। আবার যেন আমাদের মাঝে ভালোভাবে ফিরে আসেন সে কামনা করি।’
কানাডায় বসবাসরত সাবেক তারকা ফুটবলার মামুন জোয়ার্দার বলেন, ‘মহসিন বাংলাদেশের নাম্বর ওয়ান গোলরক্ষক। আমি তার সঙ্গে অনেকদিন খেলেছি। মানুষ হিসেবে চমৎকার। বাংলাদেশের একজন লিজেন্ড গোলরক্ষকের এমন পরিণতি মানতে পারছি না।’ বাংলাদেশের সেরা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ জাতীয় দলে মহসিনের সঙ্গে খেলেছেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে মোহামেডানে একসঙ্গে ছিলেন। তবে এরপর প্রধান প্রতিপক্ষ আবাহনীর হয়ে খেলেছেন মহসিন।
বেশিরভাগ সময়ে মহসিন খেলেছেন কায়সারের প্রতিপক্ষ দলে। কিন্তু মহসিনের সঙ্গে খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল কায়সারের। উচ্চতা গোলরক্ষকের জন্য অপরিহার্য একথা ভুল প্রমাণ করেছেন মহসিন। কারণ মহসিনের উচ্চতা ৬৬ ইঞ্চি, যা একজন আদর্শ গোলরক্ষকের জন্য কিছুটা কম। অথচ মহসিনকে উপরের বলে বিট করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
কয়েকবছর আগে দেশ সেরা দুই গোলরক্ষক ‘মহসিন-কানন’কে নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থকবৃন্দ মহাপাগল আয়োজন করেছিল এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের। অনেকের ধারণা ছিল মহসিনের সঙ্গে কাননের সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন আছে। অথচ সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে দুজনের চমৎকার আলাপন প্রমাণ করেছে ‘মহসিন-কানন’ বন্ধুদের মধ্যে সেরা জুটি। এ সাইদ হাসান কানন বলেন, ‘আমরা যখন দুজনেই মোহামেডানে একসঙ্গে খেলেছি তখন আমাদের দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো কে কত কম গোল খাব এ নিয়ে।’
সেই মহসিন কোথায় হারিয়ে গেলেন? বেঁচে আছেন? নাকি মারা গেছেন! কেউ জানেন না। কি অদ্ভুত ব্যাপার। যে মহসিনকে দেখলে মানুষ জটলা করে দেখতো সেই মহসিন মানুষের জটলার মাঝেই হারিয়ে গেলেন! মনে পড়ছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের কলি-
কোথায় কখন কবে
কোন তারা ঝরে গেলো
আকাশ কি মনে রাখে?
আকাশের তারকা মেঘে ঢেকে গেলেও আবার উজ্জ্বল হয়, কত তারা হারিয়ে যায় আকাশের বিশাল পরিসীমায়। তেমনি মানুষের ভিড়ে তারকারাও হারিয়ে যায়, কয়জন মনে রাখে? আশা করি কিংবদন্তি মহসিন আবারো মেঘ সরিয়ে ফিরে আসবেন সবার মাঝে।