ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ইনজুরিতে মাঠে অনিয়মিত কৃষ্ণা, দেখার কেউ নেই

রুমেল খান

প্রকাশিত: ২২:৪১, ৭ মে ২০২৪

ইনজুরিতে মাঠে অনিয়মিত কৃষ্ণা, দেখার কেউ নেই

ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত দেশের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী সরকার

সেই গত বছরের নভেম্বরে ইনজুরিতে পড়লেন। আর এখন চলতি বছরের মে চলছে। প্রায় সাত মাস হয়ে গেল, অথচ এখনো ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে পারেননি জাতীয় নারী ফুটবল দলের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী সরকার। ফুটবলপ্রেমীরা তার চোট নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেকের প্রশ্ন- ইনজুরি সারতে কতদিন লাগে? তাহলে কি ভুল চিকিৎসার কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে কৃষ্ণার ভোগান্তি? আর এজন্য কি দায়ী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)! 
গত ২৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে নারী ফুটবল লিগের ষষ্ঠ আসর। গত তিনবারের হ্যাটট্রিক শিরোপাধারী বসুন্ধরা কিংস এবার লিগে অংশ নিচ্ছে না। ফলে কিংসের ১৫ ফুটবলার (সবাই জাতীয় দলের) যোগ দিয়েছেন যাত্রাবাড়ীর ক্লাব নাসরিন স্পোর্টস একাডেমিতে। এদের মধ্যে আছেন কৃষ্ণাও। ২৯ এপ্রিল নাসরিন তাদের প্রথম ম্যাচ খেলে। প্রতিপক্ষ জামালপুর কাচারিপাড়া একাদশকে তারা উড়িয়ে দেয় ১৯-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে। এই ম্যাচে খেলতে দেখা যায়নি ২৩ বছর বয়সী স্ট্রাইকার কৃষ্ণাকে। গ্যালারিতে বসে সতীর্থদের গোলোৎসব দেখেছেন। দলের প্রতিটি গোলে উল্লাসে মেতে উঠলেও হয়তো মনে মনে ছিলেন বিষণœ। আর এটাই তো স্বাভাবিক। 
২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ আর্মি স্পোর্টস ক্লাব বনাম এআরবিসি স্পোর্টিং ক্লাবের ম্যাচ দিয়ে পর্দা ওঠে নারী ফুটবল লিগের। কৃষ্ণা এসেছিলেন ম্যাচটি উপভোগ করতে। ম্যাচটি তার জন্য ছিল অনেক আবেগের। কেননা তিনি দুই কোচ আর্মির ছোটন ও এআরবিসির বাপনের অধীনেই ইতোপূর্বে খেলেছেন। কৃষ্ণা মূলত বাপনের আবিষ্কার।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় সুতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন কৃষ্ণা। আর এই স্কুলেরই ক্রীড়াশিক্ষক ও নারী ফুটবল দলের কোচ ছিলেন বাপন। সেখান থেকে বঙ্গমাতা ফুটবল খেলে উঠে আসেন কৃষ্ণা। তারপর তার ঠাঁই হয় বাফুফের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের ক্যাম্পে। এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে খেলে স্থান পান সিনিয়র দলে। লাল-সবুজের জার্সিতে এ পর্যন্ত ৩১ ম্যাচ খেলে করেছেন দৃষ্টিনন্দন ১১ গোল। 
২৭ এপ্রিল আর্মি-এআরবিসির ম্যাচ শেষে কমলাপুর স্টেডিয়ামের মাঠে কথা হয় কৃষ্ণার সঙ্গে। ইনজুরি কি অবস্থা জানতে চাইলে জানান, ‘আগের চেয়ে অনেকটা ভালোর দিকে। নিয়মিত অনুশীলন করছি।’ তাহলে ২৯ এপ্রিল কেন খেললেন না কৃষ্ণা? অবশ্য এর জবাব দু’দিন আগেই এই প্রতিবেদকের কাছে দিয়ে রেখেছিলেন কৃষ্ণা, ‘দৌড়াতে গেলে এখনো পায়ে চিন চিন করে ব্যথা করে।

তাছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- ডাক্তার জানিয়েছেন টার্ফের মাঠে খেলতে গেলে আরও বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়তে পারি। এজন্য ঘাসের মাঠে খেলাটাই মঙ্গলজনক।’ কিন্তু বাস্তবতা ও সমস্যা হচ্ছে নারী লিগে প্রতিটি ম্যাচই অনুষ্ঠিত হবে টার্ফে। ঘাসের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এক্ষেত্রে কৃষ্ণা চলমান লিগে আদৌ মাঠে নামতে পারবেন কি না, তা নিয়ে ঢের সংশয় ছিল। যদিও পরের ম্যাচে কিছু সময়ের জন্য খেলেছেন তিনি। 
গত ডিসেম্বরে ঢাকায় সিঙ্গাপুরের দুই ম্যাচের ফিফা প্রীতি ম্যাচের সিরিজে খেলতে পারেননি কৃষ্ণা। পায়ের ইনজুরিতে ছিটকে যান এই তারকা ফুটবলার (ডান পায়ের মেটাটারসেলের চোট। পায়ের আঙুলে অনেক ব্যথা। চীনের হাংঝুতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে তিনি বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিন ম্যাচের দুটিতেই মাঠে নামতে পারেননি। ডাক্তার তিন মাসের বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দেন। পাশাপাশি চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ।

খেলা বা অনুশীলনের সময় কখন কিভাবে চোট পেয়েছিলেন কৃষ্ণা, সেটা তিনি জানেন না! অনেকেই মনে করেন চোট তার আগে থেকেই ছিল। আর এই অবস্থা নিয়েই খেলেছেন তিনি এবং সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে যায়। কৃষ্ণা নিজেও বিষয়টি নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেননি তখন। ডাক্তার তিন মাসের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ছয় মাস হয়ে গেলেও খেলার মতো ফিট হননি কৃষ্ণা। তার ডান পায়ের মধ্যমা ও চতুর্থ আঙুলের গোড়ার দিকটা শুকিয়ে গিয়েছিল।

ডাক্তার বলেছিলেন, বিশ্রামের মাধ্যমে শুকিয়ে যাওয়া আঙুলগুলোকে আবার আগের মতো জাগিয়ে তুলতে হবে। জাতীয় নারী ফুটবল দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী। তুখোড় এই ফরোয়ার্ড বাংলাদেশের প্রথম সাফ জয়ে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। ২০২২ সালে নেপালের বিরুদ্ধে ফাইনালে করেছিলেন জোড়া গোল। ২০১৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া এ ফুটবলার শুরু থেকেই দলের আস্থার প্রতীক।

২০১৪ সালে  ইসলামাবাদে সাফ চ্যাম্পিয়শিপে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে অভিষেক হয় কৃষ্ণার। ওই ম্যাচে অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করেন। ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ৬-১ গোলের বড় ব্যবধানে। সেই যে কৃষ্ণার পথচলা শুরু, এরপর টানা প্রায় ১০ বছর জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় হয়ে আছেন। গত ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচের আগ পর্যন্ত কখনোই বাদ পড়েননি।

সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ম্যাচের সময় বাংলাদেশের তৎকালীন কোচ সাইফুল বারী টিটু বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণার যে চোট, তা খুবই অস্বাভাবিক। সেটা ফুটওয়্যারের কারণে (বুট) হতে পারে। মেটাটারসালের মাঝখানে যে নার্ভ আছে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নেপালের বিপক্ষে ঢাকায় খেলায় সময় যে ওষুধ নিয়েছিল, সেটা হয়তো সাময়িকভাবে ব্যথা কমিয়েছিল, কিন্তু ওই ওষুধ নেয়া ঠিক হয়নি!’
ঘাতক চোটের কারণে দেশের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড বাইরে থাকায় অনেকের মধ্যেই দুশ্চিন্তা কাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কৃষ্ণা বাংলাদেশের সম্পদ। তার সঙ্গে অকালেই অবসরে যাওয়া সিরাত জাহান স্বপ্নার চমৎকার স্ট্রাইকিং জুটি গড়ে উঠেছিল। যদিও এখন জাতীয় দলের খেলার জন্য অপেক্ষায় আছেন সৌরভী আকন্দ প্রীতি এবং মোসাম্মৎ সাগরিকা। কিন্তু তারপরও কৃষ্ণার চেয়ে অভিজ্ঞতায় অনেক পিছিয়ে আছেন তারা।
আগামী অক্টোবরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়ন। কৃষ্ণা যদি যথাসময়ে সুস্থ হয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে বাংলাদেশ শিরোপা ধরে রাখতে পারবে কি না সন্দেহ। ফুটবলবোদ্ধারা বলছেনÑ কৃষ্ণার চোট নিয়ে গুরুত্ব দেয়নি বাফুফে। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু সেটা করেনি বাফুফে। ফলে কৃষ্ণার সুস্থ হতে বিলম্ব হওয়ার দায়ভার কোনোমতেই এড়াতে পারে না বাফুফে। কৃষ্ণার প্রতি সঠিক ও প্রয়োজনীয় যতœশীল হওয়া উচিত বাফুফের। কেননা দেশকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আছে তার। সময়মতো সুচিকিৎসা করাতে না পারলে থেমে যেতে পারে এই তারকা ফুটবলারের বর্ণময় অগ্রযাত্রা।
ছেলেবেলা থেকেই নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে চলেছেন বর্তমানে ২২ বছর বয়সী কৃষ্ণা। যে কারণে মাত্র ১৩ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার। তাইতো একসঙ্গে বয়সভিত্তিক পর্যায় ও জাতীয় দলের হয়ে মাঠ মাতিয়ে চলেছেন। কিন্তু ঘাতক চোটের কারণে দেশের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড বাইরে থাকায় অনেকের মধ্যেই দুশ্চিন্তা কাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কৃষ্ণা বাংলাদেশের সম্পদ।

দেশের নারী ফুটবলের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন এমন অনেকে মনে করছেন প্রতিভাবান এই খেলোয়াড়কে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিদেশে পাঠানো উচিত। এ বিষয়ে তারা বাফুফে ও সরকারের ক্রীড়া প্রশাসনের দৃস্টি আকর্ষন করেছেন। বর্তমানে তার যে বয়স তাতে অনন্তত আরও চার পাঁচ বছর দাপটে খেলতে পারবেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সিতে।

×