
চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বোল্ড বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটার খালেদ হাসান
টেস্ট ক্রিকেটে ২৪ বছর পার হয়েছে বাংলাদেশ দলের। শুরুর দিকে একমাত্র প্রথম শ্রেণির প্রতিযোগিতা হিসেবে জাতীয় ক্রিকেট লিগ (এনসিএল) ছিল শুধু। তখন এই আসরে মোটামুটি নিয়মিত খেলার সুযোগ পেতেন টেস্ট দলের সদস্যরা। সেজন্য অনেক অবিস্মরণীয় কীর্তিও দেখা গেছে। ২০১৩ সালে নিজেদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ৬৩৮ রান করেছে শ্রীলঙ্কার গলে।
অভিষেক টেস্টে ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে ৪০০, ২০০৬ সালে ফতুল্লায় বিশ^সেরা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪২৭, ২০১২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মিরপুরে ৫৫৬ ও ২০১৫ সালে খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬ উইকেটে ৫৫৫ রান করেছে বাংলাদেশ। এমনকি ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে পঞ্চম দিন পর্যন্ত ১৪২ ওভার ব্যাট করে ম্যাচ ড্রও করেছে ২০০৫ সালে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০৮ সালে কিংবদন্তি ক্রিকেটারে ভরা শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫২১ রানের টার্গেটে ৪১৩ রানও করেছে।
মুত্তিয়া মুরালিধর, রঙ্গনা হেরাথ ও চামিন্দা ভাসের মতো ভয়ঙ্কর বোলারদের বিপক্ষে পঞ্চম দিন পর্যন্ত ব্যাট করে ১২৬.২ ওভারে সেই পারফর্ম্যান্স দেখিয়েছেন বাংলাদেশী ব্যাটাররা। এখন সেই বাংলাদেশ খর্বশক্তির শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাটিং উইকেটেও ৮৫ ওভারে অলআউট। এ পরিসংখ্যান উন্নতির বদলে পিছিয়ে যাওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করছে। কারণ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন না টেস্ট সদস্যরা।
শ্রীলঙ্কার আহামরি কোনো বোলিং লাইন থাকলেও দুই টেস্টের সিরিজে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ ঘরের মাটিতে স্পিন সর্বস্ব একাদশ ও ঘূর্ণি ফাঁদের উইকেটে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলেছে কিছুদিন আগেই। কিন্তু লঙ্কানদের বিপক্ষে চট্টগ্রামের ব্যাটিং স্বর্গে দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১৮ রান করা বাংলাদেশ তার আগে টানা ৫ ইনিংসে ২০০ রানও করতে পারেনি। ৫১১ রানের বিশাল টার্গেটে নেমে পঞ্চম দিন ব্যাট করা কঠিন হলেও ৩১৮ রান করে কিছুটা ভালোর ইঙ্গিত অবশ্য দিয়েছে, কিন্তু এমন ফ্ল্যাট উইকেটে যেখানে বোলারদের জন্য তেমন কিছুই করার নেই সেখানে ৮৫ ওভারেই অলআউট! সেজন্যই প্রথম শ্রেণির কাঠামোয় উন্নতি করা, বেশি বেশি খেলার গুরুত্ব জানিয়েছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
আরও অনেকে বেশ আগেই এসব নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা এবার শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হওয়ার আগে টানা ৪ মাস ওয়ানডে, টি২০ খেলেছে। এর মধ্যে হয়েছে নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজ, দেশে হয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) টি২০ প্রতিযোগিতা ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে, টি২০ সিরিজ। সাধারণত সফরকারী দলের বিপক্ষে ৩ দিনের কিংবা ২ দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে কিছুটা ঝালিয়ে নেয় স্বাগতিক দল। সেই প্রস্তুতি ম্যাচে মূল টেস্ট দলের কয়েকজন খেলেন, এবার সেটিও হয়নি।
ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে এবং শান্ত বলেছেন, ‘আমাদের আরও বেশি বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা দরকার এবং যে দলের বিপক্ষে টেস্ট খেলা সেখানে আগেই ‘এ’ দল পাঠিয়ে লঙ্গার ভার্সনের ম্যাচ খেলা প্রয়োজন।
বর্তমানে দেশে দুটি প্রথম শ্রেণির আসর। এনসিএল ছাড়াও হয়ে থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ (বিসিএল)। অথচ ২০১৩ সালে বিসিএল শুরু হওয়ার আগে এনসিএলে মোটামুটি টেস্ট দলের খেলোয়াড়রা খেলেছেন। তাই তাদের পারফর্ম্যান্সও দেখা গেছে। এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, ঘরোয়া ক্রিকেট এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মিলিয়ে অনেক চাপ থাকায় অধিকাংশ ক্রিকেটারই এনসিএল খেলার সুযোগ পান না ঠিকমতো।
সেই সঙ্গে ‘এ’ দল কিংবা এইচপি দলের দেশে ও দেশের বাইরে নিয়মিত পূর্ণাঙ্গ সিরিজ হয় না ও সেসব সিরিজে লঙ্গার ভার্সনের ম্যাচ খেলার সুযোগ নেই। সবমিলিয়ে তাই ভরাডুবি। অথচ ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটের নবীন সদস্য বাংলাদেশ দল দারুণ এক কীর্তিই গড়ে। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ৩৭৪ রানের টার্গেট দেয় জিম্বাবুয়ে। চতুর্থ দিন ৫৭ ওভার ব্যাট করেও কোনো উইকেট হারায়নি বাংলাদেশ, বিনা উইকেটে তোলে ৯৮ রান।
পঞ্চম ও শেষদিন জিততে ২৭৬ রান দরকার হলেও সেই ঝুঁকির দিকে যাননি কেউ। উদ্বোধনী জুটি হয়েছে ১৩৩ রানের। জাভেদ ওমর বেলিম ২৫৮ বল খেলে মাত্র ৪৩ রানে বিদায় নেন আর আরেক ওপেনার নাফিস ইকবাল ৩৫৫ বল মোকাবিলায় করেন ১২১! পরের দিকে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ২৯ বলে ২, রাজিন সালেহ ১৪০ বলে ৯ চারে অপরাজিত ৫৬ ও খালেদ মাসুদ পাইলট ৫৭ বলে ২৮ রানে অপরাজিত থাকেন। শেষদিন ৮৫ ওভার ব্যাট করেছে বাংলাদেশ- ৫ উইকেট হারালেও রান করেছে মাত্র ১৮৭! সবমিলিয়ে ১৪২ ওভার ব্যাট করে ৫ উইকেটে ২৮৫ রান করে ম্যাচটি ড্র করে বাংলাদেশ।
২০১৪ সালে চট্টগ্রামেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পঞ্চম দিন ব্যাট করে ড্র করেছে বাংলাদেশ। সেবার ৪৬৭ রানের টার্গেটে চতুর্থ দিন শেষে ৮ ওভারে বিনা উইকটে ১২ রান করা বাংলাদেশ পঞ্চম দিন শেষ বিকেল পর্যন্ত সর্বমোট ৮৪.৪ ওভার ব্যাট করে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে ২৭১ রান করে। দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ১০২ বলে ৩১ ও শামসুর রহমান ৯৮ বলে ৪৫ রান করে। পরের দিকে ইমরুল কায়েস ৬৬ বলে ২৫, মুমিনুল হক ১৬৭ বলে ১০০ ও সাকিব আল হাসান ৮৮ বলে ৪৩ রানে অপরাজিত থেকে লঙ্কানদের ড্র মানতে বাধ্য করেন।
২০০৮ সালে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই আরেকটি টেস্টের ঘটনা এখন পর্যন্ত মনে রাখার মতোই। সেবার মিরপুরে বক্সিং ডে টেস্টে বাংলাদেশকে ৫২১ রানের টার্গেট দেয় লঙ্কানরা। জয়াবর্ধনের নেতৃত্বে ওই দলে ছিলেন সাঙ্গাকারা, থিলন সামারাবিরা, তিলকারতেœ দিলশান এবং বোলিংয়ে ছিলেন কিংবদন্তি ৩ বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরন, চামিন্দা ভাস ও রঙ্গনা হেরাথ। সেই দলটির বিপক্ষে পঞ্চম দিন চা বিরতির কিছু আগে পর্যন্ত ব্যাট চালিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াকু বাংলাদেশ ৪১৩ রানে গুটিয়ে যায়।
সেই ইনিংসে তামিম ৫৩ বলে ৪৭, জুনায়েদ সিদ্দিকী ৭৪ বলে ৩৭, মোহাম্মদ আশরাফুল ১৯৩ বলে ১০১, সাকিব ২১২ বলে ৯৬ ও মুশফিকুর রহিম ১১১ বলে ৬১ রান করেন। ১০৭ রানে হেরে গেলেও বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম একটি ম্যাচ সেটি। সবমিলিয়ে ১২৬.২ ওভার ব্যাটিং করে বাংলাদেশ সেই ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে। এখন আর তেমন দেখা যায় না, তাই পিছিয়ে গেছে দেশের টেস্ট ক্রিকেট এমনটাই বলছেন সবাই।