রুমেল খান ॥ বিশ্বকাপ চায়ের কাপের মতো কোন সহজলভ্য বস্তু নয় যে, চাইলেই যে কোন সময় এটা পাওয়া যায়। এটার জন্য তৃষ্ণার্ত চাতক পক্ষীর মতো অপেক্ষা করতে হয় চার বছর ধরে। শুধু অপেক্ষা করলেই হবে না, এটাকে পেতে হলে অনেক কিছু করতে হবে। যেমন : সদিচ্ছা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম, অর্থ, সুযোগ-সুবিধা এবং সব শেষে ভাগ্যের একটুখানি পরশ। অনেক সময় দেখা যায় খেলায় সবকিছুর সমন্বয় হলেও শুধুমাত্র ভাগ্যের অভাবেই অনেক দল হেরে যায় দুভার্গ্যজনকভাবে। যেমন ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে দুই গোলে এগিয়ে থেকেও জার্মানির কাছে শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলে তৎকালীন সবচেয়ে শক্তিশালী-অপরাজেয় দল হাঙ্গেরীর পরাজয়টা আজও রহস্য হয়ে আছে। তেমনি সর্বকালের সেরা ফুটবল দলগুলোর একটি ১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল অসাধারণ খেলেও ইতালির কাছে ৩-২ গোলে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয়। ব্রাজিলের এই হার আজও অনেকের কাছে ঠিক যেন বিশ্বাস হয় না। আসলে হাঙ্গেরী-ব্রাজিলের দুই দলের বেলাতেই যা হয়েছে, তা ছিল ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়া। এই যেমন ফ্রান্সের কথাই ধরা যাক। বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত শক্তি তারা। এ নিয়ে তারা বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছে পঞ্চদশবারের মতো। ফাইনাল খেলে দু’বার। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে একবার (১৯৯৮)। রানার্সআপ হয়েছে একবার (২০০৬)। তৃতীয় হয়েছে দু’বার (১৯৫৮ এবং ১৯৮৬)। চতুর্থ হয়েছে একবার (১৯৮২)। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়েছে দু’বার (১৯৩৮ এবং ২০১৪), প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়েছে ছয় বার (১৯৩০, ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৭৮, ২০০২ এবং ২০১০)। এ পর্যন্ত মূলপর্বে তারা খেলেছে ৫৯ ম্যাচ। জিতেছে ২৮, ড্র করেছে ১২ এবং হেরেছে ১৯ ম্যাচে। ১০৬ গোল করার বিপরীতে হজম করেছে ৭১ গোল। কোন সন্দেহ নেই, বেশ ঈর্ষণীয় পরিসংখ্যান। কিন্তু এসব কোন কাজেই আসবে না, যদি তারা এবার চ্যাম্পিয়ন হতে না পারে। তার কারণ এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে ফ্রান্সের শিরোপা জেতার ব্যাপারে বেশ উচ্চ ধারণাই পোষণ করেছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণাকে সঠিক প্রতিপন্ন করেই এ পর্যন্ত বেশ ভালভাবেই ‘ফরাসী-সৌরভ’ ছড়িয়ে এসেছে দিদিয়ের দেশমের দল। ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে তারা। হারায় অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ এবং পেরুকে ১-০ গোলে। গোলশূন্য ড্র করে ডেনমার্কের সঙ্গে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ৪-৩ গোলে হারায় দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে। কোয়ার্টারে হারায় দুইবারের শিরোপাধারী উরুগুয়েকে, ২-০ গোলে। সেমিতে পৌঁছায় ২০০৬ আসরের পর। আগামী ১০ জুলাই শেষ চারের লড়াইয়ে ‘লেস ব্লিউস’ খ্যাত এবং সপ্তম ফিফা র্যাঙ্কিংধারী ফ্রান্স মোকাবেলা করবে তৃতীয় ফিফা র্যাঙ্কিংধারী এবং ‘দ্য রেড ডেভিলস্’ খ্যাত বেলজিয়ামের। হেড টু হেড লড়াইয়ে দু’দল মুখোমুখি হয়েছে ৭৩ ম্যাচে। এতে জয়ের পাল্লা ভারি ১৯৮৬ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো সেমিফাইনাল খেলতে যাওয়া বেলজিয়ামেরই। ৩০ ম্যাচে জিতেছে তারা। ২৪ ম্যাচে জিতেছে ফ্রান্স। বাকি ১৯ ম্যাচ ড্র হয়। গোল করাতেও এগিয়ে বেলজিয়াম (১৬০-১২৭)। তবে বিশ্বকাপের মূলপর্বের মোকাবেলায় আবার এগিয়ে ফরাসীরাই। ২ ম্যাচের মধ্যে প্রতিটিতেই জিতেছে তারা (১৯৩৮ আসরে গ্রুপ পর্বে ৩-১ এবং ১৯৮৬ আসরে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ৪-২ গোলে)।
তবে রাশিয়া বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে ফ্রান্সের খেলা সেভাবে মন ভরাতে পারেনি। তাদের খেলার ধরন ছিল কিছুটা একঘেয়েমিপূর্ণ। এজন্য কিছুটা সমালোচিতও হতে হয়েছে দলটিকে। তবে নকআউট স্টেজে গিয়েই আমূল বদলে যায় তাদের মানসিকতা এবং খেলার ধরন। আক্রমণাত্মক ধাঁচে খেলে বিদায় করে দেয় দুই পরাশক্তি আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়েকে। তাদের সামনে টিকতেই পারেনি দল দুটি। এর পরেই একটি প্রশ্ন ফ্রান্সের সামনে চলে আসেÑ তারা কি ২০ বছর পর আবারও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে? এ প্রসঙ্গে ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম (১৯৯৮ বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের খেলোয়াড় ছিলেন) বলেন, ‘আমরা এখনও শিরোপা নিয়ে ভাবছি না। আমরা এগোতে চাই ধাপে ধাপে। আমাদের ভাবনায় এখন শুধুই সেমিফাইনাল। দেখা যাক কি হয়।’
অনেকেই আবার ফ্রান্স দলের মাঝে ১৯৮২ বিশ্বকাপজয়ী ইতালির ছায়া দেখছেন। সেবার গ্রপ পর্বে ইতালি আহামরি কোন খেলা খেলেনি (পোল্যান্ডের সঙ্গে ০-০ ড্র, পেরুর সঙ্গে ১-১ ড্র, ক্যামেরুনের সঙ্গে ১-১) । অনেকটা খুঁড়িয়েই দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে তারা। সেখানেই অভাবনীয় নৈপুণ্যে এগিয়ে যেতে থাকে তারা। একে একে হারায় আর্জেন্টিনাকে ২-১, ব্রাজিলকে ৩-২, সেমিতে পোল্যান্ডকে ২-০ এবং ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-১ গোলে। ৬ গোল করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ফরোয়ার্ড পাওলো রোসি।
এবার সেই ইতালির পথেই ফ্রান্স হাঁটছে। শেষ পর্যন্ত কি ফ্রান্স হতে পারবে ১৯৮২ বিশ্বকাপের ইতালির মতো?
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: