ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মথ -আফরোজা পারভীন

প্রকাশিত: ০৮:০৪, ১৪ জুন ২০১৮

মথ -আফরোজা পারভীন

জবা একা ভালোই ছিল। একা লাগত, সব কাজ একা করতে হতো, শেয়ার করার কেউ ছিল না ঠিকই কিন্তু বিপরীত দিকও ছিল। ইচ্ছেমতো চলাফেরা যেতো, কারো কাছে জবাবদিহি করতে হতো না। জবাবদিহি যে আগে করতে হতো এমনটাও না। অবারিত স্বাধীনতা দিয়ে জবাকে পরাধীন করে ফেলেছিল শাহেদ। তাই বাইরে বের হলেই ঘরে ফেরার তাড়া থাকত। বিশেষ করে যেদিন শাহেদ বাড়িতে থাকত। মনে হতো ও বাড়িতে একা আছে। অফিস থেকে ফিরে সেই থেকে একা। আর মানুষটা এতই ভালো যে, ওকে একবার জিজ্ঞাসাও করবে না কোথায় গিয়েছিলে, এত রাত হলো কেন? জিজ্ঞাসা করলে মেজাজ দেখানো যেতো। কিন্তু যে জবার সব ভাল লাগাকে মেনে নিয়েছে তার ভালো লাগাকে তো একটু দাম দিতেই হয়। শাহেদ মুখে বলেনা ঠিকই কিন্তু জবা বুঝতে পারে ও ঘরে থাকলে শাহেদ খুব খুশি হয়। ওর ফরসা রংটা আরও উজ্জ্বল দেখায়। সদা হাসিমাখা মুখটা যেন হাসিতে উপচে পড়ে। কারণে অকারণে জবাকে ডাকে আর একটু পর পর বলে, ‘একটু চা হবে?’ কালো কুটকুটি অপানযোগ্য চা হলেও বলে, ‘দারুণ চা হয়েছে তো। আহ্।’ অথচ ওই চা এক চুমুক দিয়ে ফেলে দেয় জবা। রাগী চোখে তাকালে বলে, ‘বিশ্বাস করো তোমাকে খুশি করার জন্য বলিনি। আসলে চাটা ভালোই হয়েছে।’ জবা বিশ^াস করে। শাহেদের যদি চা খারাপ লাগতো ওর চেহারা ঠোঁট মুখের চামড়ায় কুঞ্চন হতো। হয়নি। ও নিজেকে লুকাতে জানে না, অভিনয়ও জানে না। এ ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত জবা। তাই জবা খুব কম বাইরে যায়। প্রতিবেশী ভাবিদের সঙ্গে নিউমার্কেট আর এবাসা ওবাসা। এর বাইরে কোথাও না। এ নিয়ে ভাবিরা হাসাহাসিও করে। জবাকে খুশি করতে পারলে কীযে খুশি হতো শাহেদ। জবা ফুল ভালবাসে তাই সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝেই দুটো তাজা গোলাপ নিয়ে আসত। ঠিক সন্ধ্যার মুখে যখন ঘরে গোলাপের গন্ধ ভাসতে থাকত জবা বুঝত শাহেদ এসেছে। ও দরজা খুলে দিতো। শাহেদ অবাক হয়ে বলত, : বুঝলে কী করে। আমি তো বেল বাজাইনি? : ওই যে তোমার হাতের গোলাপই জানিয়ে দিয়েছে। হাসি প্রসারিত হতো। গন্ধের কতো ক্ষমতা। বাতাসে ভাসে, নাকে ঢোকে, মনে নাড়া দেয়, মস্তিস্কের নিউরোন জেগে ওঠে। তাইতো জবা দরজা খোলে। ও গোলাপ দুটো জবার হাতে দিতো। আর জবা সঙ্গে সঙ্গে খোঁপায় গুঁজে ফেলত। গুন গুন করতে করতে ঘুরঘুর করে চা বানাতো, খাবার সাজাতো, টিভি ছাড়তো। তারপর শাহেদের গা ঘেঁষে বসত। শাহেদ সেই ঘেঁষাটাকে আরও একটু নিবিড় করে নিত। দু’জনে দু’জন মগ্ন হতো অক্লেশে। সে মগ্নতা কখনও কখনও রান্না করতে ভুলিয়ে দিতো জবাকে। মগ্নতা ভেঙে গভীর রাতে দুজন দেখত হাঁড়িতে ভাত নেই। সেই মাঝরাতে রান্না শুরু হতো, যৌথ রান্না। ভাত আলুভর্তা ডিমভাজি। নিজে না খেয়ে থাকতে রাজি শাহেদ কিন্তু জবাকে অভুক্ত থাকতে দেবে না কিছুতেই। বেশ একটা পিকনিক পিকনিক হানিমুন হানিমুন ভাবের মধ্য দিয়েই দিনগুলো কাটছিল। দু’জন মানুষ, অভাব নেই, সিমেনা দেখা, শপিং বেড়ানো, লেকের ধার পূর্বাচল কোনটাতেই পয়সায় টান পড়ে না। চাহিদা বেশি নেই। ওরা খায় দায় ঘুরে বেড়ায় দুটিতে মগ্ন হয়ে। মগ্নতার এক পর্যায়ে একদিন ফুরফুরে হাওয়ায় নদীকে সাক্ষী রেখে খোলা আকাশের আচ্ছাদনে গোলাপের ঘ্রাণ নিতে নিতে জবা বলল, : আমাকে তুমি ভালবাসো? : এ কেমন বোকা বোকা প্রশ্ন! তুমি বোঝ না। না বুঝে থাকলে আমি আসলেই তোমাকে ভালবাসি না। : প্যাচ খেলিও না। সরাসরি বলো ভালোবাসো? : হু, খুউব। আর তুমি? : হু।: আমি মারা গেলে তুমি বিয়ে করবে? : ছি : ছি: মরার কথা উঠছে কেন! জবার হাত শক্ত করে চেপে ধরে শাহেদ। সে হাতের কাঁপুনি স্পষ্ট বুঝতে পারে জবা। : না না বলতে হবে, বলো? যুগে যুগে স্বামীকে এ প্রশ্ন স্ত্রীরাই আগে করেছে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না : প্রশ্নই নেই। কোনদিন বিয়ে করব না। শতভাগ নিশ্চিন্ত থাকো। : দেখা যাবে। কিন্তু তুমি জানতে চাইলে না যে ! : জানার দরকার নেই, আমি জানি। কি জানে আর জানতে চাইলো না জবা। পৃথিবীতে নাকি অবিমিশ্র সুখ বলে কিছু নেই সেটা প্রমাণ হলো। শাহেদ ছিল জীবনবাদী মানুষ। শাহেদের ডায়াবিটিস ছিল। ও পাত্তা দিতো না। বলত, ডায়াবিটিস কোন অসুখই না। মৃত্যুচিন্তা তার মধ্যে ছিল না। বরং জবা মাঝে মাঝে অসুখে পড়ত। আর অসুখে পড়লেই ওর মন দুর্বল হতো। টেনে আনত সেই পুরোনো প্রসঙ্গ। : আমি মারা গেলে তুমি নিশ্চয়ই আর একটা বিয়ে করবে? : ধ্যাৎ সেই জীবনবাদী শাহেদ সিসিইউতে গেল। দিন কয়েকে থেকে ফিরেও এলো। কিন্তু মন ভাঙলো না ওর। ঘরে ফিরে হাসতে হাসতে বলল, : এবার আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব। ডায়াবিটিসে কেউ মরে না। একটু কন্ট্রোল করতে হবে এই যা! তুমি শুধু শুধু ভয় করছিলে। ভয়টা যে শুধু শুধু ছিল না তা প্রমাণ হয়ে গেল দ্রুত। একরাতে শাহেদের সুগার নেমে যেতে থাকল। জবা যখন ওকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গলদঘর্ম ও জবার হাত চেপে ধরল : আমি মরতে চাই না। তোমাকে ফেলে যেতে চাই না। আমাকে ফেলে কোথাও যেও না। বিয়ে করো না যেন। : করব না কথা দিলাম। হাসপাতালে নেবার পথেই চলে গেল শাহেদ। দুই একাই চলছিল জবা। ঘর বাজার দোকান সব। ওর জীবন থেকে লেক সিনেমা থিয়েটার গোলাপ হারিয়ে গিয়েছিল। তা নিয়ে ওর কোন আক্ষেপ ছিলো না। বরং ও শাহেদের স্মৃতি চয়ন করে ভরপুর হয়ে থাকত। একা মনে হতো না কখনই নিজেকে। মনে হতো শাহেদ ওর সঙ্গেই আছে। বাড়ির দরজা থেকে শাহেদের নাম সরালো না, ঘরের সামনে দু’জনের নামের নেমপ্লেট ঝুলতে লাগল আগের মতোই। মোবাইল থেকে ওর নাম্বার মুছল না। আর সারাবাড়ি ভরে ফেলল ওর ছবিতে। যেন যেদিকেই চোখ পড়ে ওকে দেখতে পায়। বেডরুম ড্রইংরুম করিডর ডাইনিং ভরে ফেলল ছবি দিয়ে। যেন দেখতে পায় ঘুমানোর আগে, ঘুম ভেঙে। মুহূর্তের জন্য যেন ভুলে না থাকে। ভুলবে না সে এটা ঠিক। তারপরও লালন করতে হয়, পরিচর্যা করতে হয় সব সম্পর্ক। নিজ হাতে প্রতিদিন ছবির ধুলো মোছে। নিয়ম করে কবরস্থানে যায়। কবরের চারপাশে গাছ লাগায়। শাহেদের বইগুলো ঘেটে ঘেটে দেখে। দেখে কখনও মনে আনন্দ নিয়ে, কখনও চোখে জল নিয়ে। চেষ্টা করে শ্বশুরবাড়ির লোকের সঙ্গে আগের চেয়ে যোগাযোগ বাড়াতে। যত যোগাযোগ হবে ততই যাতায়াত বাড়বে আর শাহেদের সম্পর্কে কথবার্তা হবে। শাহেদের প্রসঙ্গ কেউ তুললে বড় ভাল লাগে জবার। কোনদিন দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভুলেও ভাবেনি। জবার চিন্তার চৌহদ্দিতেও দ্বিতীয় বিয়ে ছিল না। ভেবেছিল এভাবেই জীবনটা কেটে যাবে। সে শাহেদকে কথা দিয়েছে। সে কথা রাখবে। তাছাড়া শাহেদ তো তার সঙ্গে আছেই। দু’বছর পর জবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। গলব্লাডার অপারেশন। অপারেশনের পর ডাবল বেডের কেবিন নিয়েছিল। পাশের কেবিনের রোগী ননী আপা। তার ভাই সৌরভ বোনকে দেখতে আসত প্রতিদিন। বোনকে যতটা সেবা করত ততটাই করত জলিকে। বোন তেমন কিছু মনে করত না। সৌরভের চেয়ে বয়সে বড় জবা। নির্দোষ সেবা হিসেবেই নিয়েছিল। আর জবারও হাসপাতালে নিয়মিত দেখা করা, খোঁজ খবর করা, ওষুধ পত্র এনে দেয়ার মতো কেউ নেই। শ্বশুরবাড়ির লোকদের খবর দিয়েছিল। একবারটির জন্য আসেনি। আর জবার একমাত্র বোন বিদেশে। তাই এই সেবাটুকু তার কাছে অমূল্য মনে হয়েছিল। রিলিজ হবার আগে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই যোগাযোগটা চুকেবুকে যাবার কথা, যায়নি। ও বাড়ি ফেরার পর পরই ফোন এসেছিল। শরীর কেমন, ক্লান্ত লাগে কিনা এসব চলল কদিন। তারপর একজন অসুস্থ মহিলাকে একটু সাহায্য করার জন্য বাড়ি আসা শুরু হলো। তার জন্য দুটো ফল এনে দেয়া, চাপাতি ফুরিয়ে গেছে আনতে মনে নেই এনে দেয়া, এই করে বাসায় আসা কেমনভাবে যেন একসময় নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে বুঝতেই পারেনি জবা। যখন বুঝল জল ততদিনে অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। কিভাবে যেন জবাকে ওর ওপর নির্ভরশীল করে ফেলেছে সৌরভ। জবা চেষ্টা করল সরে থাকতে। নির্ভরশীলতা বড় খারাপ জিনিস, আর অভ্যস্ততা আরও খারাপ। কিন্তু পারলো না। সৌরভের তরফ থেকে লাগাতার পাশে থাকার, কাছে থাকার প্রতিশ্রুতি ওকে দুর্বল করে দিল। একা থাকা সত্যিই খুব কষ্টের। নিঃসঙ্গতার চেয়ে বড় অসুখ আর নেই। শারীরিক যত অসুখ-বিসুখ সবই নিঃসঙ্গতা প্রসূত। আর কেউ না বুঝলেও জবা বোঝে। দিনান্তে কথা বলার একটা মানুষও নেই। তারপরও পিছু টান। শাহেদের জায়গায় অন্য কাউকে বসানোর কথা সে ভাবতেই পারে না। সৌরভ বুঝালো, : দেখ শাহেদ ভাই-এর জায়গায় আমাকে তুমি বসাবে কেন। শাহেদ ভাই কতো সম্মানিত মানুষ। তার সঙ্গে কি আমার কোন তুলনা চলে! উনি থাকবেন ওনার জায়গায় আমি আমার জায়গায়। আমি শুধু তোমাকে একটু সঙ্গ দিতে চাই, এতটুকুই। তোমাকে দেখে আমার কষ্ট হয়। কবে কবে যে জবাকে তুমি বলতে শুরু করেছে সৌরভ সেটাও বোঝেনি জবা। : আমি কিন্তু ওকে কোনদিনই ভুলতে পারব না। ওকে নিয়ে কোনদিন কিছু বলতে পারবে না আমাকে। আমি ওকে খুব ভালবাসি। : প্রশ্নই আসে না। তুমি যেমন ওনাকে ভালবাসো, সম্মান করো আমিও করি। কোনদিন কিছু বলার প্রশ্নই আসে না। শাহেদকে ভালবাসার কথা জানালো কিন্তু ওকে যে সে কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে না সে কথাটা সৌরভকে বলল না। বিয়ে হয়ে গেল। দিন গড়িয়ে চলল। সময়ের প্রবাহমানতায় স্মৃতির গায়ে ধুলোও জমতে থাকে। এখন আর আগের মতো আঁচল দিয়ে শাহেদের ছবি মোছা হয় না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকাও হয় না, নিয়মিত কবরস্থানে যাওয়া হয় না। ইচ্ছে হলেও সবসময় করতে পারে না। সৌরভ কিছুই বলে না। তারপরও কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে। তাছাড়া আগের চেয়ে কাজও বেড়েছে। সৌরভের জন্য রান্না, তার অফিসে টিফিন গুছিয়ে দেয়া, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা, ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়া এমন অনেক কাজ। এখন আর সময় বাঁচে না, নিঃসঙ্গও লাগে না। এরপর একদিন আস্তে করে দরজা থেকে নেমেপ্লেটটা সরে নতুন নেমপ্লেট উঠল। তার কিছুদিন পর একটু একটু করে শাহেদের ছবি সরতে লাগল। কিছু বলতে পারল না জবা, সৌরভের দিকে তাকালো। সৌরভ বলল, : দেখ শাহেদ ভাইয়ের ছবি থাকলে আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি অতটা অনুদার নই। উনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন আমি জানি। কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন আসে তারা কি ভাববে বলত? আমরা তো বিয়ে করেছি তাই না, স্বামী স্ত্রী। বিশেষ করে ধরো যদি বেডরুমে থাকে। জবা কিছু বলতে পারল না। ওর চোখের সামনে থেকে একে একে বেডরুমের ছবিগুলো খুলে নিলো সৌরভ। ঢুকিয়ে দিল খাটের নিচে। যে খাটে থাকে সৌরভ আর জবা ঠিক তার নিচে রইল শাহেদ। তিন সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দুটো গোলাপ আনল সৌরভ। জবার হাতে দিলো। আজ কিন্তু গোলাপের কোন গন্ধ পায়নি জবা। জবা বলল, : হঠাৎ গোলাপ আনলে যে! : আনলাম। তুমি বলেছিলে শাহেদ সাহেব রোজ তোমার জন্য গোলাপ আনত। শুধু উনি না। আমিও আনি। খোঁপায় পরো জবার কানে শাহেদ সাহেব কথাটা খট করে লাগল। ও কিছু না বলে গোলাপটা খোপায় গুঁজল। খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় অন্তরঙ্গ হলো ওরা। শরীরের চাহিদা দু’জনেরই বেশি। অনেক রাত অবধি গল্প করল ওরা। সৌরভ তার অফিসের নতুন বসের গল্প করছিল। বস মহিলা লোকাট ব্লাউজ পরে। পিঠের অনেকটাই অনাবৃত থাকে। এসব গল্প করতে করতে উত্তপ্ত সৌরভ জবাকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিলো। ঘরে বাতি জ্বলছে। বিয়ের প্রথম দিকে এ নিয়ে কিছু সমস্যা হয়েছে ওদের। সৌরভের অভ্যাস বাতি জ্বালিয়ে ঘুমানো। আর বাতির মাঝেই আকাক্সক্ষা মিটানো। জবা এতে অভ্যস্ত নয়। এদেশের বেশিরভাগ মেয়েই অভ্যস্ত নয়। প্রথম যেদিন এটা ঘটল জবা প্রতিবাদ করেছিল, : বাতি নিভাও কি অসভ্যতা হচ্ছে : আমার না দেখলে ভাল লাগে না : বাতি জ্বালানো থাকলে আমি ওসব পারবো না। আমার লজ্জা করে : লজ্জার কি আছে, আমিই তো। নগ্ন তোমাকে যদি আমি দেখতেই না পেলাম, তুমি যদি আমাকে দেখতে না পেলে তাহলে এসবের দরকার কি। থাক দরকার নেই। সৌরভের জেদে বাধ্য হয়েছিল জবা মেনে নিতে। খারাপ লাগত জবার। অত আলোর নিচে অনাবৃত নিজেকে দেখে কুঁকড়েও যেতো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন বরং বাতি না থাকলেই খারাপ লাগে। আজও বাতি জ্বলছে। ঠিক যখন সৌরভ নিবিড় চুম্বনে জলির ঠোঁট দুটো ছিঁড়ে নিতে চাইছে, জবাকে কাছে টেনে বেণীর মতো একটু করে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে গ্রাস করতে চাইছে যখন তখন সামনের অনাবৃত দেয়ালে চোখ পড়ল জবার। দেয়ালে বসে আছে বড়সড় একটা মথ। জ¦লজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখ দুটো জ¦লছে। ছেলেবেলায় মার কাছে শুনেছে প্রিয়জন কবরে যদি কষ্টে থাকে কোন কারণে, যদি কষ্ট পায় সে নিজের লোকের কাছে আসে। তাহলে কী শাহেদ এসেছে? জবার খোঁপার গোলাপ ও নিশ্চয়ই দেখেছে। ও জানতে পেরেছে জবা বিয়ে করেছে। জবার বিয়ে ও সহ্য করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। শাহেদ বিয়ে করলে জবা কি সহ্য করতে পারত! মথের চোখ দুটো বরাবর জবার ওপর নিপতিত। নির্ণিমেষে দেখছে ওকে। সে চোখ থেকে ঝরে পড়ছে কষ্ট। শীতল হয়ে যায় জবা। বিনুনি আলগা হয় জবার। হাত পা ছেড়ে দেয়। সৌরভ উত্তাপ হারানোর পথে ধাবিত হতে হতে বলে, : কি হলো তোমার? : আমার শরীর খারাপ লাগছে। আজ থাক : কিন্তু আমিতো। একটু চেষ্টা করো না। : না থাক। রোজ রোজ হতে হবে তার মানে কি। বলছি তো আমার শরীর খারাপ লাগছে। অসন্তুষ্ট চিত্তে নেমে আসে সৌরভ। বাথরুমে চলে যায়। আর জবা বিছানা থেকে উঠে বার বার মথটাকেই দেখে। ওর একটুও ঘুম হয় না। জবা মার কাছে শুনেছিল মথ এলে দুধ পানির ছিঁটে দিলে সে সন্তুষ্ট হয়ে চলে যায়। জবা পরদিন অনেকবার দুধ পানির ছিঁটে দিলো, যায় না যায় না। সহজে কী সরতে চায় ওটা, সরে না, সরে না। সরাতে অনেক কষ্ট হলো। মথ চলে যাবার পর একটু স্বস্তি পেলো জবা তবে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। হু হু করে কাঁদল অনেকক্ষণ। অফিস থেকে ফিরে জবার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে সৌরভ বলল, : তোমার চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন, শরীর কি এখনও খারাপ? : হ্যাঁ : কি হয়েছে, চলো ডাক্তারের কাছে যাই। : ডাক্তার লাগবে না রাতে বিছানায় ওকে কাছে টানল সৌরভ। ছিটকে সরে গেল জবা : বললাম না আমার জ¦র : জ¦রেই তো বেশি সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে। তোমার করে না? : না করে না : আমার করে। গতরাতে তার বাড়াভাতে চাই পড়েছে । তেঁতে আছে সে, জবার উপর কিঞ্চিৎ রাগও। টেনে নিলো আগ্রাসী বেষ্টনে। আর ঠিক তখনই আগের দিনের মতো মথটাকে একই জায়গায় দেখল জবা। ছিটকে উঠে বসল বিছানায়। এ ঘটনা ঘটতে লাগল দিনের পর দিন। এক সময় বিরক্ত হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাতি নিভালো সৌরভ। তাতেও শেষরক্ষা হলো না। অন্ধকারে জ¦লতে লাগল মথের চোখ দুটো। কোন দোয়া দরুদে কাজ হলো না। রাগ করে পাশে সৌরভ ঘুমাতে থাকে। মথ আর জবা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রাত জাগে। পরদিন মথকে তাড়াবার একই চেষ্টা চালায় জবা, যায় না মথ। আর আজ জবার কোন আপত্তিই শুনতে চায় না সৌরভ। অনেকটা জোর করে উপগত হয়। জবা চোখ বন্ধ করে থাকে। দাম্পত্য স্বাভাবিক গতিতে শেষ হয় না। সৌরভ বলে, : তোমার হয়েছে কি বলত। তোমার শরীর কি এতই খারাপ! ডাক্তার দেখাতে বললে দেখাও না। আবার না আছে কোন আবেগ না উচ্ছ্বাস না কোন চাহিদা। মনে হয় বাধ্য হয়ে তুমি আমার সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছ। এতে কিন্তু কোন আনন্দ নেই। বিয়ের পর এই প্রথম সৌরভের কণ্ঠে অস্তুষ্টির স্বর ফুটে ওঠে। কিন্তু কি করবে জবা। মথ যে যায় না। গেলে আবার ফিরে আসে। দিনের পর দিন যায়, সৌরভের অসন্তুষ্টি বাড়ে, ওদের দূরত্ব বাড়ে। সৌরভ দ্রুত বদলে যেতে লাগল। শুরু হলো কথাকাটাকাটি, রাগারাগি। সবচেয়ে বিরক্ত হলো সৌরভ জবা বারবার মনের ডাক্তার দেখাতে অস্বীকার করায়। ওর স্থির বিশ^াস জবার কোন মানসিক রোগ হয়েছে। অল্পে ট্রিটমেন্ট করলে সেরে যাবে। কিন্তু মানসিক ডাক্তারের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ¦লে উঠল জবা : মানসিক ডাক্তারের কাছে যাবো মানে, আমি কি পাগল। তুমি আমাকে পাগল বানাতে চাও! অশান্তি চরমে উঠল। এভাবে চললে ঘর ভাঙতে আর সময় লাগবে না। তাকে সংসার বাঁচাতে হবে। সেদিন সকাল থেকে অনেকক্ষণ গুম হয়ে থাকে জবা। কোন একটা কঠিন ডিসিশন যেন নিতে যাচ্ছে সে। তারপর আস্তে আস্তে ঝাড়ু হাতে ওঠে। দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মথ তাকিয়ে আছে। জবার হাতে ঝাড়ু দেখে যেন ওর চোখে বিস্ময়। জবা ঝাড়ু উঁচু করে, ওঠায় থেমে যায় তারপর পিটাতে থাকে পিটাতে থাকে। মথটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। বলছে, আমাকে তুমি মারছ জবা, মেরে ফেলতে চাচ্ছ। আমাকে যে তুমি ভালবাসতে। একসময় ঝপ করে পড়ে যায় মথ। দু-এক বাড়ির পর আর নড়ে না। জবা সযতেœ মথটাকে ওঠায়। তারপর ছোট্ট একটা পলিথিনে ভরে ময়লা ফেরার জায়গা দিয়ে ফেলে দেয়। দশতলা থেকে পলিথিন গিয়ে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে। একতলারও নিচে। স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলে জবা ঘরে ফিরে আসে। অনেকক্ষণ কাঁদে। তারপর সাজতে বসে। কপালে বড় করে টিপ দিয়ে চোখে কাজল আঁকল। লম্বা বেণী বাঁধল। বেণীটা সাপের মতো দুলতে থাকল। ধানী রঙের শাড়ি পরে অপেক্ষা করতে লাগল সৌরভের। সৌরভ ঢুকল গম্ভীর মুখে। দরজাতেই ওকে জড়িয়ে ধরল জবা। সৌরভ শক্ত থাকতে গিয়ে গলে মাখন হলো। ওকে জাপটে ধরে অবাক হয়ে বলল, : এত সেজেছ যে! আজকাল তো সাজতে ভুলে গেছ! জবা রহস্যময় হাসি হাসল। অনেকদিন পর ওরা একসঙ্গে বহুক্ষণ ধরে গল্প করতে করতে চা খেলো, রাতে দু’জন দু’জনের প্লেটে খাবার তুলে দিলো। আয়েস করে দুটো পানও খেলো ওরা। তারপর বিছানায় গেলো। আজ পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেবে জবা। বেচারা অনেক দিন ধরে কিছু পায়নি। পায়নি জবাও। তার আকাক্সক্ষাও কি কম! আজ সৌরভকে নিজেই জড়িয়ে ধরে জবা। কাছে টেনে নেয়। নিজের ঠোঁট দুটোয় পুরে নেয় ওর পুরু ঠোঁট। অতিমাত্রায় ক্রিয়াশীল ওর দুটো হাত। ততোধিক ক্রিয়াশীল হলো সৌরভের হাতও। নিষ্পিষ্ট হতে হতে চোখ দুটো যখন মুদে আসছে প্রায় তখনই ওকে চিত করে সৌরভ। জবার চোখ যায় দেয়ালে। মথটা বসে আছে আগের জায়গায়। আজ ওর চোখে শুধু ঘৃণা আর বিদ্বেষ। জবা দেখল জ¦লজ¦লে দুটো চোখ যেন ওকে গিলতে আসছে। আসছে, আসছে। আপ্রাণ চেষ্টায় বাধন আলগা করল জবা। বাতি জ¦ালাল। হ্যাঁ মথটা বসে আছে দেয়ালে, ঠিক যেখান থেকে কাল মেরেছিল সেখানে। : কী হলো হলো কী? সৌরভের কণ্ঠে রাগ ক্ষোভ আগ্রাসন। জবা ছিটকে পড়ে বিছানা থেকে। ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সারারাত ঘরে ঢোকে না। পরদিন সৌরভ জবাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ও ভেবেছিল জবা বাধা দেবে। দেয় না। ও যায়। তবে ও জানে, ওর কোন অসুখ নেই। শাহেদ আসে। আসবে। ওই মথই তার শাহেদ।
×