সম্পাদকীয়
সোমালিয়ার উপকূলে টানা ৩৩ দিন জিম্মিদশা থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশের কেএসআরএম গ্রুপের বাণিজ্য জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। শনিবার দিবাগত রাতে সোমালীয় জলদস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার পর মুক্তি পান ২৩ বাংলাদেশী নাবিক। এরপর তারা জাহাজটি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের পথে অগ্রসর হন। সেখানে ২২ এপ্রিল নাগাদ পৌঁছাতে পারে জাহাজটি।
কেএসআরএম সূত্র জানিয়েছে, নাবিকরা চাইলে দুবাই থেকে আকাশপথে দেশে ফিরতে পারেন অথবা জাহাজ যোগেও পৌঁছাতে পারেন চট্টগ্রামে। উল্লেখ্য, মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাওয়ার সময় গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। সেই থেকে সরকার, সংশ্লিষ্ট মালিক কর্তৃপক্ষ এবং কর্মরত নাবিকদের পরিবার-পরিজন ও স্বজনদের দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত কেটেছে অনিদ্রা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-দুশ্চিন্তায়।
সর্বাধিক আশঙ্কার বিষয় ছিল জাহাজের নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তা এবং জিম্মিদশা থেকে মুক্তি নিয়ে। এর সঙ্গে জাহাজটি উদ্ধারের বিষয়টিও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জাহাজ এবং নাবিকদের উদ্ধারের জন্য বলপ্রয়োগের আদৌ কোনো সুযোগ ছিল না। সেক্ষেত্রে নাবিকদের জীবন এবং জাহাজ উদ্ধারের বিষয়টি ছিল একেবারেই অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে, সোমালীয় জলদস্যুদের সঙ্গে বিকল্প কূটনৈতিক পথ তথা আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই ছিল সর্বাধিক উত্তম পন্থা। যেটি শেষ পর্যন্ত কাজ করেছে এবং সুফল বয়ে এনেছে।
মূলত মুক্তিপণের বিনিময়েই সোমালীয় জলদস্যুরা ২৩ জন নাবিকসহ বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ছেড়ে দিয়েছে। জলদস্যুদের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে ৫০ লাখ ডলার, বাংলাদেশী প্রায় ৫৫ কোটি টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে কেএসআরএম গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুক্তিপণের অর্থের হিসাবটি সঠিক নয়। অবশ্য এটিও ঠিক যে, দু’পক্ষের মধ্যে ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ হওয়ায় সঠিক তথ্য প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।
মুক্তিপণের সঠিক তথ্য জানে কেবল কেএসআরএম গ্রুপ, জলদস্যু দল এবং মধ্যস্থতায় যুক্ত বিমা কোম্পানি। অবমুক্ত হওয়ার পর জাহাজটির নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি যুদ্ধ জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে দুই পাশ থেকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে।
সাগর-মহাসাগরে জলদস্যুদের উৎপাত উপদ্রবসহ জাহাজ ছিনতাই এবং নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়টি নতুন নয়। সমুদ্রপথে বিশেষ করে মানুষের চলাচল এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গে জাহাজ ছিনতাইয়ের বিষয়টি জড়িত প্রায় আদিকাল থেকেই। তবে ইদানীং এর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। অত্যাধুনিক দ্রুতগতিসম্পন্ন ছোট জলযান এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এর তীব্রতা ও ভয়াবহতা বাড়াতে হয়েছে সহায়ক। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে এর উৎপাত বেশি।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ এই অঞ্চলে জাহাজ চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সমূহ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। একদিকে লোহিত সাগরে হুতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলা, অন্যদিকে সোমালীয় জলদস্যুদের জাহাজ ও নাবিকদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় আন্তর্জাতিক জলপথকে রীতিমতো বিপদগ্রস্ত করে তুলেছে। সে অবস্থায় সমুদ্রপথ ও নৌ-বাণিজ্যের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় এবং পরাশক্তিগুলোর এগিয়ে আসা অত্যাবশ্যক।