ইসলাম প্রসঙ্গে
পবিত্র মহরম মাসের ঘটনাবহুল আশুরা দিবস অত্যাসন্ন। এর আগের মাসে অনুষ্ঠিত হলো পুণ্যভূমি আরব দেশে পবিত্র হজ। পাশাপাশি দেশে দেশে মুসলমানরা কোরবানি পর্ব সম্পন্ন করেন। জিলহজের দশম তারিখ আল্লাহ তায়ালার প্রেম ও ভালবাসায় ইব্রাহীম নবী (আ.) নিজ প্রাণপ্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে ৬১ হিজরী/৬৮০ খ্রিস্টাব্দের মহরমের দশম তারিখ নূর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নাহ আদর্শ ও খিলাফতের মর্যাদা অক্ষুণ্ড রাখার মানসে কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেছিলেন নবী তনয়া মা ফাতিমা (রা.) এর প্রাণের দুলাল ইমাম হুসাইন (রা.)। শহীদে কারবালা ইমাম হুসাইনের মা, সে সময়কার ইসলামের প্রচার প্রসারে তাঁর আত্মত্যাগ ও পবিত্র খানায়ে কাবায় তাঁর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজ কিছু আলোচনা।
হযরত রাসূলে কারীম (সা.) নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে মক্কা নগরীতে হযরত ফাতিমা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সায়্যিদুল কাওনায়ন রাসূলু রাব্বিল আলামীন আবুল কাসিম মুহাম্মাদ ইবনে ’আবদিল্লাহ এবং মাতা সারাবিশ্বের নারী জাতির অনুপ্রেরণা, প্রথম মুসলমান উম্মুল মু’মিনীন খাদিজা বিনতে খুওয়ায়লিদ (রা.)। ফাতিমার যখন জন্ম হয় তখন মক্কার কুরাইশরা পবিত্র কা’বা ঘরের সংস্কার কাজ চালাচ্ছে।
সেটা ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। ফাতিমার জন্মগ্রহণে তাঁর মহান পিতা-মাতা দারুণ খুশি হন। ফাতিমা ছিলেন কনিষ্ঠা মেয়ে। মা খাদিজা (রা.) তাঁর অন্য সন্তানদের জন্য ধাত্রী রাখলেও ফাতিমাকে ধাত্রীর হাতে ছেড়ে দেননি। তিনি তাঁর অতি আদরের ছোট মেয়েকে নিজে দুধ পান করান। এভাবে হযরত ফাতিমা (রা.) একটি পূতপবিত্র গৃহে তাঁর মহান পিতা মাতার তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন এবং নবুওয়াতের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারায় স্নাত হন।
হযরত রাসূলে কারীম (সা.) এর ওপর ওহী নাজিল হবার পর উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদিজা (রা.) সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর রিসালাতকে সত্য বলে গ্রহণ করেন। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি প্রথম পর্বে যেসব মহিলা ঈমান আনেন, তাদের পুরো ভাগে ছিলেন তাঁর পূতপবিত্র কন্যাগণ। তাঁরা হলেন : যায়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা (রা.)। তাঁরা তাদের পিতার নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রতি ঈমান আনেন তাঁদের মহীয়সী মা খাদিজার সঙ্গে।
হযরত রাসূলে কারীম (সা.) এর ওপর ওহী নাজিল হলো। তিনি আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের নির্দেশ মতো মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতে লাগলেন। এজন্য তিনি স্থানীয় স্বার্থপর সমাজপতিদের পক্ষ থেকে বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, অত্যাচার-নির্যাতন, অস্বীকৃতি, মিথ্যা দোষারোপ ও বাড়াবাড়ির মুখোমুখি হলেন। হযরত ফাতিমা (রা.) তখন জীবনের শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছেন। পিতা যে তাঁর জীবনের একটা কঠিন সময় অতিবাহিত করছেন, মেয়ে ফাতিমা এত অল্প বয়সেও তা বুঝতে পারতেন।
একবার উকবা মক্কার পাপাচারী কুরাইশদের একটি বৈঠকে বসা ছিল। কয়েকজন কুরাইশ নেতা বলল, এই যে দেখ মুহাম্মদ সিজদায় আছেন। এখানে উপস্থিতদের এমন কে আছে, যে উটের এই পচাগলা নাড়িভুঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে তাঁর পিঠে ফেলে আসতে পারে? নরাধম উকবা অতি উৎসাহ ভরে এই অপকর্মটি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে বলল। তারপর সে দ্রুত পচা নাড়ি ভুঁড়িগুলো উঠিয়ে সিজদারত মুহাম্মদ (সা.) এর পিঠের ওপর ফেলে দিল।
দূর থেকে কুরাইশ নেতারা এ দৃশ্য দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হযরত রাসূলে কারীম (সা.) সিজদা থেকে উঠলেন না। সঙ্গে সঙ্গে এ খবর বাড়িতে হযরত ফাতিমার (রা.) কানে গেল। তিনি ছুটে এলেন, অত্যন্ত দরদের সঙ্গে নিজ হাতে পিতার পিঠ থেকে ময়লা সরিয়ে ফেলেন এবং পানি এনে পিতার দেহে লাগা ময়লা পরিষ্কার করেন।
কিশোর বয়সে ফাতিমা পিতার হাত ধরে একদিন গেছেন কা’বার আঙ্গিনায়। তিনি দেখলেন, পিতা যেই না হাজরে আসওয়াদের কাছাকাছি গেছেন, অমনি একদল পৌত্তলিক একযোগে তাঁকে ঘিরে ধরে। এর পরের ঘটনা দেখে বালিকা ফাতিমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তিনি ভয়ে অসাড় হয়ে পড়েন। দেখেন, তাদের একজন তাঁর গায়ের চাদরটি তাঁর গলায় পেঁচিয়ে জোরে টানতে শুরু করেছে।
আর আবু বকর (রা.) তাদের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে বলছেন: তোমরা একটি লোককে শুধু এ জন্য হত্যা করবে যে, তিনি বলেন : আল্লাহ আমার রব, প্রতিপালক? লোকগুলো আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল। আবু বকরকে (রা.) নাজেহাল করল, তাঁর মাথা ফাটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে ছাড়ল।
এভাবে আবু বকর (রা.) নিজের জীবন বিপন্ন করে পাষ-দের হাত থেকে মুহাম্মদকে (সা.) ছাড়ালেন। ছাড়া পেয়ে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। মেয়ে ফাতিমা পিতার পেছনে পেছনে চললেন। রাসূল (সা.) সোজা বাড়িতে গেলেন এবং মারাত্মক রকমের বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। বালিকা ফতিমার চোখে এ ধরনের হাজারো দুঃসহ স্মৃতি ছিল ইসলামের মহান নবীকে নিয়ে।
আরেকবার অনাহারে মারার জন্য তিন বছর ধরে তাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল শিবু আবু তালিবে। তখন নারীশিশু ও বৃদ্ধদের কান্নার আওয়াজে মক্কার আকাশ-বাতাস হয়ে পড়েছিল শোকাহত।
অবরুদ্ধ জীবনের দুঃখ-বেদনা ভুলতে না ভুলতে তিনি আরেকটি বড় রকম দুঃখের মুখোমুখি হন। স্নেহময়ী মা হযরত খাদিজা (রা.), যিনি তাঁদের সবাইকে আগলে রেখেছিলেন, যিনি অতি নীরবে পুণ্যময় নবীগৃহের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে চলছিলেন, ইন্তেকাল করেন। তিনি আল্লাহর রাসূলের (সা.) যাবতীয় দায়িত্ব যেন কন্যা ফাতিমার ওপর অর্পণ করে যান।
তিনি অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ়তার সঙ্গে পিতার পাশে এসে দাঁড়ান। পিতার আদর ও স্নেহ বেশি মাত্রায় পেতে থাকেন। আর এ কারণেই তাঁর ডাকনাম হয়ে যায়- ‘উম্মু আবীহা’ (তাঁর পিতার মা)। - (সূত্র : নিসা’ মুবাশ্শারাত বিল জান্নাহ, আল ইসাবা-৪)।
আজ আমরা পবিত্র মক্কাভিত্তিক হজ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকি, তাওয়াফ করি, হাজরে আসওয়াদে চুমু দেই, মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে নামাজ পড়ি। এসব বড়সড় আকর্ষণ হাজীদের সফরে। তবে এগুলো কোন নতুন বিষয় নয়, প্রত্যেক কালে যে যে ধর্মাবলম্বী হোক না কেন আরববাসীদের জন্য এসব ইবাদত অনুষ্ঠান ছিল নিয়মিত এবং পরম গর্বের।
এসব নিয়ামত ভোগ করা থেকেও তারা আমাদের নবীজীকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছে। যা হযরত ফাতিমা নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। পরবর্তীতে মহানবী (সা.) মাকামে ইব্রাহীম, হাজরে আসওয়াদ বা কৃষ্ণ পাথরের মর্যাদায় অনেক কথা বলেছেন। তিরমিযী শরীফে সাহাবী আমর বিন আ’স হতে বর্ণনা রয়েছে যে, তিনি বলেছেন: আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) বলতে শুনেছি নিশ্চয়ই হাজরে আসওয়াদ এবং মাকামে ইব্রাহীম বেহেশতের দুটি ইয়াকুত পাথর।
আল্লাহ এ দুটো পাথরের নূর মিটিয়ে দিয়েছেন...।’ ফাকিহী উল্লেখ করেছেন, জিবরাঈল (আ.) মাকামে ইব্রাহীমকে নিয়ে এসে হযরত ইব্রাহীম (আ) এর পায়ের নিচে রেখে দেন। - (সূত্র: মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃ. ৩১৫)।
হজের মৌসুমে অসাধ্য কষ্টকর হয় হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া। এতে প্রচ- ভিড়ে নারী-পুরুষদের নাজেহাল হতে হয়। তাই আমরা হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়ার বিষয়ে সাধারণত নিরুৎসাহিত করি। আমরা যারা এখনও শক্তিধর নওজোয়ান -চুমু দেয়ার আগ্রহ জাগলে রাত নিশিতে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে মাতাফ বা তাওয়াফের স্থলে নেমে পড়ি।
এবার হজের সময়টি ছিল আরও বিচিত্র, বেদনাকাতর। সে করোনাকাল থেকে পবিত্র হাজরে আসওয়াদ, পবিত্র মুলতাজিম, পবিত্র হাতিম, পবিত্র রোকনে ইয়েমেনী চুমু দেয়া, প্রাণ ভরে ধরা নিষিদ্ধ হয়েই থাকল। এসব একটি ঘেরাওয়ের মধ্যে অধরা রেখে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাদের এসব বিষয় স্পর্শ করে জীবন মন উদ্দীপ্ত করার সুদিন এনে দিন। (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব