রাজনৈতিক বলয়ে থেকেও বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের গবেষণা নিয়ে আলাদা জগত তৈরি করেছিলেন যিনি, তিনি আমাদের প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ধাপ পরমাণু নিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো কাজটি তিনি করে গেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য এমন একজন বিজ্ঞানী অপরিহার্য ছিল। বাংলাদেশের আণবিক পাওয়ার প্লান্টের এই স্বপ্নদ্রষ্টা আজ আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই পরমাণু বিজ্ঞানী নানাভাবে বাঙালী জাতির পরম আপনজনে পরিণত হয়েছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণ করে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত দেশে পরিণত করার এক স্বপ্ন ছিল তার। যা তিনি তার জীবন ও কর্মে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের। এই মহান বিজ্ঞান সাধকের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৯ সালের ৯ মে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই পরমাণু বিজ্ঞানী তার জীবদ্দশায় আন্তরিকতা, প্রতিভা ও মানবিক গুণাবলী দিয়ে চারপাশের মানুষকে যেমন মুগ্ধ করেছেন, তেমনই ভালবাসা ও দেশপ্রেম দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে জাতির জন্য কাজ করে গেছেন। জাতির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার জন্য ড. ওয়াজেদ মিয়া সকলের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন এবং তার অবদানের জন্য মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ করবে।
স্বপ্নবান এই বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ‘একটা উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে সম্পদ অপ্রতুল সেখানে একমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই জাতির জন্য সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারে।’ কথায় নয়, তার কাজেও আমরা সেই প্রতিফলন দেখেছি। তার জীবনের সবগুলো কর্মময় বছরই তিনি নিবেদন করেছেন বিজ্ঞান এবং তার পেছনের মানুষগুলোকে মহিমান্বিত করার কাজে।
পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে যতই জেনেছি- অবাক হয়েছি ততই। বার বার আমার মানসপটে তার অবয়বটি দেখতে পেয়েছি এ রকম- তিনি যেন ক্লান্তিহীন। বিজ্ঞানকে সামাজিক উন্নয়নে আরও অর্থবহ করে তোলার জন্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে এগিয়ে নেয়ার নতুন নতুন সুযোগের সন্ধানে মত্ত। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে ছিল তার কাজের শেষদিন। ৩৬ বছরের কর্মস্থলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সে দিনটিতেও তার কর্মোদ্যম একটুও স্তিমিত হয়ে যায়নি। একটা মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি অবিচলভাবে প্রতিশ্রুত থাকার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি।
১৯৪২ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞান সাধক ছাত্রজীবনেও তুখোড় মেধাবী ছিলেন। মেধার কারণে তিনি একের পর এক সাফল্যের সঙ্গে সকল শিক্ষা বৈতরণী পার হন। যা সমসময়ে সহপাঠীদের কাছে তার আলাদা পরিচয় তৈরি করে দেয়। তার জীবনের দিকে দৃষ্টি নিপতিত করলে দেখা যায়, মেধাবী ছাত্র বা পরমাণু বিজ্ঞানী, এর বাইরেও অনেকগুলো গুণবাচক শব্দ ধারণ করেছিলেন তিনি। যা আমাদের এক মুগ্ধতার আবেশে তাকে নিয়ে ভাবতে উজ্জীবিত করে। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, নীতিবান, নিরহঙ্কার, নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, সৎ, সহজ-সরল, বিনয়ী, চরিত্রবান, যুক্তিবাদী, অজাতশত্রু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ। এত গুণে গুণান্বিত মানুষ ক’জন আছেন এই ভুবনে। ওয়াজেদ মিয়াকে প্রিয়জনরা ডাকতেন ‘সুধা মিয়া’ নামে। বাবা ছিলেন আবদুল কাদের মিয়া, মা ময়জু নেসা বিবি। রংপুরের পিছিয়ে পড়া জন্মগ্রাম ফতেহপুরেই বেড়ে ওঠেন তিনি। মেধাবী হিসেবে ছোটবেলাতেই শিক্ষকদের দৃষ্টি কাড়েন তিনি।
১৯৬৩ সালের ৯ এপ্রিল তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে যোগ দেন। এরপর ’৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডারডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার এ্যান্ড হাই এনার্জি পার্টিকেল ফিজিকস-এ পিএইচডি করেন।
এই সাধক বিজ্ঞানের সঙ্গে কতটা জড়িয়ে ছিলেন তা তার কর্মজীবনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা ছাড়াও ইতালির ট্রিয়েসটের আন্তর্জাতিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে একাধিকবার গবেষণা করেছেন। তিনি গবেষণা করেছেন ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনেও। তার গবেষণা ও জ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে আণবিক রিএ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লীর ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা ট্র্যাজেডির পর গোটা পরিবারের হাল ধরেন ওয়াজেদ মিয়া। ৮১ সাল পর্যন্ত নির্বাসিত জীবনে ভারতীয় পরমাণু শক্তি কমিশনের বৃত্তির টাকায় সংসার চালিয়েছেন তিনি। সর্বশেষ চাকরি করেছেন পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে। ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন চাকরি থেকে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকার বিক্রমপুর জগদীশ চন্দ্র বসু সোসাইটি তাকে ১৯৯৪ সালে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু স্বর্ণপদক এবং ম্যাবস ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা ১৯৯৭ সালে পদক প্রদান করে।
আজ বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প। বলা যায় এটা তার স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের এই পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পূরণ হবে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সফল হবে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার আমরণ প্রচেষ্টা এবং সুফল ভোগ করবে সারাদেশের মানুষ।’
ড. ওয়াজেদ মিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে যারা চিনতেন, কাছ থেকে দেখেছেন, তারা এক বাক্যে তার সততা ও মোহমুক্ততা নিয়ে প্রশংসায় মেতে ওঠেন। সহকর্মীদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন সৎ ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান হওয়ার জন্য। তিনি নিজে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও কোন সুযোগ-সুবিধা নেননি। কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। সর্বদা নিজস্ব বলয়ে থেকে নিজের যোগ্যতায় নিজ কর্মক্ষেত্রের পরিধিতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কর্মজীবন শেষ করেছেন।
লেখক : সচিব, বাংলাদেশ সরকার