ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

নতুন সরকারে দায়িত্বে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই ॥ লন্ডনে চ্যাথাম হাউসের সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা

ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন হবে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৩৩, ১১ জুন ২০২৫

ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন হবে

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, চ্যাথাম হাউজে বক্তব্য রাখেন

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকারে তাঁর থাকার কোনো ইচ্ছা নেই জানিয়ে বলেছেন, আগামী বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ১৭ বছর পর আমরা সত্যিকারের একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছি, যা আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন হবে।
বুধবার লন্ডনের প্রভাবশালী নীতিগত গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস আয়োজিত এক সংলাপে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। 
এক সাংবাদিক প্রধান উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেন, নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচিত সরকার যখন দায়িত্ব নেবে, সেখানে আপনার অংশ হওয়ার কোনো ইচ্ছে আছে কি না। জবাবে দুই হাত নেড়ে হাস্যোজ্জ্বল ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলতে থাকেন, ‘নো ওয়ে, নো ওয়ে (একদমই না)। আমার মনে হয়, আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্যই এমনটা করবেন না।

আমাদের দায়িত্ব হলো, ট্রানজিশনটা (গণতান্ত্রিক রূপান্তর) ভালোভাবে সম্পন্ন করা এবং জনগণকে খুশি করা। নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। আমরা নির্বাচনটা যথাযথভাবে করা নিশ্চিত করতে চাই। এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্ববহ বিষয়। যদি নির্বাচন ভুল হয়, তাহলে এই বিষয়টার আর সমাধান হবে না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৭ বছর পর আমরা সত্যিকারের একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছি। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো নির্বাচন হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু একটি নতুন সরকার নির্বাচনের জন্য রক্ত দেয়নি বাংলাদেশের তরুণরা। তারা চেয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশ।
নতুন বাংলাদেশ তৈরির জন্য সংস্কার কমিশন করা হয়েছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কমিশন তৈরি করেছি। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে আমরা সামনে এগোচ্ছি। এখন আমাদের মূল দায়িত্ব হলো সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা। 
এ সময় আরেক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা জুলাই সনদ আসার জন্য অপেক্ষা করছি। এই সনদটি জাতির সামনে জুলাই মাসের সনদ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে।
অপর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশে হাজারো মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে কিন্তু শেখ হাসিনা বা তার দল এখনো সেই হত্যার জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি। তার ওপর ভারত থেকে প্রতিনিয়ত মিথ্যা ও ভুল সংবাদ প্রচার অব্যাহত রয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। এই বিচার আইনি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে। একইভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরতের বিষয়টিও আইনি প্রক্রিয়ায় হবে। 
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশকে আমরা নতুন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এটা অনেক কঠিন একটি কাজ। আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেম কলাপস করেছিল। এখন ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স বেড়েছে। আগের থেকে অবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আইওএম খুব পজিটিভ রোল নিয়েছে। আমাদের সামনে দেশ গড়ার এখন একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। আমরা সবাই একযোগে কাজ করলে দেশ এগিয়ে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। আমরা তাদের ফিরিয়ে নিতে কাজ করছি। এ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করছি। জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনেরও আয়োজন চলছে।
বক্তব্যের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা একটি ভুল সভ্যতার অংশ হয়ে গেছি, আমরা নিজেরাই একটি আত্মবিধ্বংসী সভ্যতা গড়ে তুলেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদের দরকার নতুন করে সভ্যতা গড়ে তোলা। এর জন্য দরকার কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা, বেকারত্ব দূর করা এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া। এটার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা কোনো শিক্ষা বা জ্ঞানের বিষয় নয়।’
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যদি একটি সংগঠন হত্যা, গুম এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তবে সেটিকে রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটা কোনো চূড়ান্ত রায় নয়, বরং একটি বিতর্কের বিষয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর মনে হয়েছিল এই অধ্যায় শেষ, কিন্তু যারা দেশত্যাগ করেছিল, তারা এখনো দুঃখপ্রকাশ করেনি, বরং জনগণকে উস্কানি দিচ্ছে। জাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশ ও রাজনীতির নিরাপত্তার স্বার্থে বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখতে হবে।’
আলোচনাকালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা দাবি করেন, ‘গণমাধ্যম এত স্বাধীনতা আগে কখনো পায়নি।’
আরেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভাঙচুর, সেক্ষেত্রে প্রশাসনের নীরবতা এবং নির্দিষ্ট দল বা ব্যক্তি বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্ন তুললে প্রধান উপদেষ্টা স্বীকার করেন যে, সব সঠিকভাবে সামলানো সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এটা এমন এক ধরনের সময়কাল, যার মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। সবই একসঙ্গে এসেছে। জাতীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, গবেষক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা। সংলাপে ড. ইউনূস বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন।
সংস্কারে সহায়তা করতে আগ্রহী কমনওয়েলথ ॥ কমনওয়েলথ মহাসচিব শার্লি আয়র্কর বোচওয়ে বলেছেন, আগামী বছরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সংস্কারে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আগ্রহী সংস্থাটি। বাংলাদেশ যদি চায় বিশেষ করে সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য, তাহলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
বুধবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বোচওয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করা আগামী পাঁচ বছরের জন্য কমনওয়েলথের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংগ্রামে সহায়তা করাও সংগঠনের অগ্রাধিকারভিত্তিক লক্ষ্য।’
কমনওয়েলথ ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন জনগণের প্ল্যাটফর্ম  উল্লেখ করে  কমনওয়েলথ মহাসচিব বলেন, বর্তমানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৮৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আগামী কয়েক বছরে তা কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘কমনওয়েলথের অনেক সদস্য রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এর মধ্যে অনেক দেশ আকারে অত্যন্ত ছোট। আমরা তাদের জলবায়ু অর্থায়নে প্রবেশাধিকার পেতে সহায়তা করার চেষ্টা করব।’
এ সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কমনওয়েলথ মহাসচিবকে ক্রীড়া খাতে সম্ভাবনা অনুসন্ধান এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ক্রীড়া শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও। আমরা ক্রীড়াবিদদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য উৎসাহ দিচ্ছি। কমনওয়েলথের স্মরণীয় হয়ে ওঠার জন্য ক্রীড়া হতে পারে একটি ভালো মাধ্যম।’
কমনওয়েলথ মহাসচিব জানান, চলতি মাসে তারা ঢাকায় একটি যুব প্রোগ্রাম আয়োজন করতে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, কমনওয়েলথের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন জনগণ তরুণ এবং তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার জন্য তারা কাজ করছেন। তারা কমনওয়েলথ বৃৃত্তিগুলো পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও করছেন, একটি ক্ষেত্র যা প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
সাক্ষাৎকালে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাক্ষাৎ ॥ যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েল বুধবার  লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার সফরকালীন আবাসস্থল হোটেলে এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়। 
বৈঠকে দুদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিয়ে আলোচনা হয়।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আসন্ন জাতিসংঘ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের সক্রিয় সমর্থন কামনা করেন এবং দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, পূর্ববর্তী সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তিনি পাচারকৃত এই অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
জোনাথন পাওয়েল বাংলাদেশের এই সংকটকালে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অব্যাহত সমর্থন প্রদানের প্রস্তাব দেন। বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে ইতিবাচক অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসার বিষয়েও আলোচনা হয়।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী এবং এসডিজি সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদ।
প্রসঙ্গত, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার লন্ডনে পৌঁছান। চারদিনের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করা। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে আরও শক্তিশালী করা।

×