ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মীমাংসাগুলো যেন একেকটি গল্প

হতদরিদ্ররাও পাচ্ছে বিচার

বিকাশ দত্ত 

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ১১ জুন ২০২৫

হতদরিদ্ররাও পাচ্ছে বিচার

হতদরিদ্ররা এখন আর কোনো করুণার পাত্র না

হতদরিদ্ররা এখন আর কোনো করুণার পাত্র না। তারা আর অবহেলিত নয়। তারাও এখন বিচার পাচ্ছেন। এতদিন যাদের অবহেলিত ভেবে করুণা করা হতো, এখন সেই সমস্ত  হতদরিদ্্র জনগোষ্ঠীর পাশে আছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা বা লিগ্যাল এইড অফিস। যারা অর্থের অভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারেন না তাদের আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয় এই সংস্থার মাধ্যমে। প্রতিদিন পত্রিকা ম্যাগাজিনে মানুষের সুখ-দুঃখ, সাফল্য, যন্ত্রণা, হতাশা, দুর্দশাসহ অসংখ্য জীবনের কাহিনী প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায়।

কোন গল্প আশা জাগায়, জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, বেঁচে থাকার সার্থকতা ও মর্ম বোঝায়; আবার কোনো কোনো গল্প আমাদের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে, পৃথিবীটাকে একটা নিষ্ঠুর বসবাসযোগ্যহীন জায়গা হিসেবে মনে করিয়ে দেয়। লিগ্যাল এইড অফিস এমন একটা স্থান যেখানে প্রতিনিয়ত এসব সুখ-দুঃখের অনেক গল্প দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো গল্পের সমাধান হয় সাফল্যের আবার কোনো কোনো গল্পের উত্তর হয় ব্যর্থতা। এমন কয়েকটি সাফল্যের গল্প তুলে ধরা হলো। এই গল্পগুলো তৈরিতে সহায়তা করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাবলিক রিলেশন অফিসার ড. মো. রেজাউল করিম। 
মানিকগঞ্জের রাকিব আফরিনার সংসারে যে ঝামেলা ছিল তার মীমাংসা হয়েছে। দীর্ঘদিন বিবাদের পর পূর্ণিমা বেগম (৭০) জমি ফিরে পেয়েছেন। রাঙ্গামাটির হতদরিদ্র ভ্যানচালক আসাদ আলীর লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে জমি ফিরে পেয়েছেন। শুধু এরাই নয় ১৬ বছরে ১২ লাখ ৭ হাজার ৯৯৩ জন আইনি সহায়তা পেয়েছেন। এ সময়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে ২৫৭ কোটি ৭ লাখ ২১ হাজার ৪৩৫ টাকা। সুপ্রিম কোর্টে হতদরিদ্ররা আইনি সহায়তা পেয়েছে ২৮ হাজার ৯৬৫ জন।

কারাগারে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ১ লাখ ২৭ হাজার ৯৩ জন। এই সময়ের মধ্যে মামলা হয়েছে ৪ লাখ ২৪ হাজার ১৮১টি। আইনি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি। এ ছাড়া আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭৯টি। 
শুরুতে জেলা পর্যায়ে অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর জন্য এ আইনি সেবা প্রদান শুরু হয়। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা ও চট্টগ্রামে শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল, দেশের কারাগারগুলোতে এ সেবা চালু হয়। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাইকোর্ট বিভাগের  বিচারপতি কাজী জিনাত হক।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত ১৩ মার্চের এক স্মারকে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান পদে হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী জিনাত হককে মনোনয়ন প্রদান করেছেন। জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার অধীনে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১৫ সালে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের অধীনে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
মনিকগঞ্জ জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় এমনই একটি জটিল বিষয় মীমাংসা করেছে। এটি একটি পারিবারিক সংক্রান্ত অভিযোগ। আবেদনকারী রাকিব দেওয়ান ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট প্রতিপক্ষ তার শ্বশুর আক্কাস আলী এবং তার শাশুড়ি তাসলিমা বেগমের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ করেন যে, তার স্ত্রী আফরিনা আক্তার গর্ভবতী হলে নাইওরের কথা বলে প্রতিপক্ষগণ তার স্ত্রীকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে প্রতিপক্ষগণের প্ররোচনায় ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট আফরিনা অকাল গর্ভপাত ঘটান।

এরপরও রাকিব তার স্ত্রীকে ফেরত আনার বহু চেষ্টা করলেও আফরিনা ফেরত আসে না। রাকিব আফরিনার সঙ্গে সংসার করতে ইচ্ছুক বিধায় তাকে ফেরত চায়। অভিযোগ গ্রহণ করে মীমাংসা সভার তারিখ ফেলা হয় ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। ওই তারিখে রাকিব এবং প্রতিপক্ষগণের সঙ্গে আফরিনা যথাসময়ে উপস্থিত হন জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে। দুপক্ষের কথা মনোযোগ দিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে শোনা হয়। দুপক্ষকেই বিভিন্ন প্রশ্ন করে তাদের বিস্তর কথা শোনার পর মূল বিষয়টি একে একে বেরিয়ে আসে। প্রতিপক্ষগণের দাবি, ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট  আফরিনা কোনো ধরনের কোনো গর্ভপাত ঘটাননি বরং তিনি তার শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে ডাক্তার দেখান এবং তাকে ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাম করার উপদেশ দেন।

ওই তারিখে আফরিনা আল্ট্রাসনোগ্রাম করান এবং রিপোর্টটি অত্র কার্যালয়ে পেশ করেন। রিপোর্টটি ভালোমতো পর্যবেক্ষণে  সন্তানের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি মর্মে দেখা যায়। রাকিবকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি ভেবেছিলেন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা এবং সন্তান নষ্ট করার জন্য সে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। এই ভুল বোঝাবুঝির নিষ্পত্তি করা হলো। রাকিবকে বোঝানো হলো যে, শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কারও বিরুদ্ধে এ রকম গুরুতর অভিযোগ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পরবর্তীতে আরও কথা বলার পর বের হলো মূল সমস্যা। আসলে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অপরের সঙ্গে সংসার করতে চান। তবে স্ত্রী সংসারের পাশাপাশি তার পড়াশোনাটাও চালিয়ে নিতে চান। কিন্তু রাকিব তাকে পড়াতে ইচ্ছুক নন। তাই কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য আফরিনা তার পিতা-মাতার বাড়িতে চলে যান এবং সেখানে একটি কলেজে ভর্তি হন। আফরিনা এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবেন। এ নিয়েই রাকিবের সঙ্গে প্রতিপক্ষ ও আফরিনার গ-গোল বাধে। রাকিব নিরক্ষর। তার মতামত এই যে, বিয়ের সময় স্ত্রী যে পড়াশোনা করবে এই বিষয়টি প্রতিপক্ষগণ তাকে জানাননি।

সে যেহেতু একজন দিনমজুর সেহেতু এই করোনা পরিস্থতিতে বর্তমানে তার কোনো আয় রোজগার নেই। সে কীভাবে এই সময়ে তার স্ত্রীর পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করে পুরো সংসার চালাবে সেই বিষয়ে সে সন্দিহান। এদিকে আফরিনার বক্তব্য এই যে, সে স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে চায়, সংসারের কাজকর্মেও তার কোনো আপত্তি নেই তবে এর পাশাপাশি সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। 
এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব তাহলে? সমস্যার সমাধানে এবার এগিয়ে এলেন জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা সহকারী জজ সুবর্ণা সেঁজুতি। তিনি ওই মহিলার স্বামীকে বোঝান একটা মানুষের জন্য লেখাপড়াটা কতটা জরুরি। শিক্ষা মানুষের জীবনকে কীভাবে পাল্টে দেয় এবং তাদের সন্তানের জন্যও একটি শিক্ষিত মা কতটা জরুরি। যেহেতু রাকিব নিজেই নিরক্ষর তাই তার সংসারে একজন শিক্ষিত মানুষ থাকা আরও জরুরি। রাকিবকে শিক্ষার মর্ম বোঝানো এতটা সহজ ছিল না। কিন্তু হাল ছাড়লেন না জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা। বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে প্রেক্ষাপট বুঝিয়ে অবশেষে রাকিবকে বোঝানো গেল। রাকিব স্ত্রীকে পড়তে দেবেন বলে রাজি হলেন।

কিন্তু আফরিনার পড়াশোনার খরচের ব্যাপারে কি হবে। এবার আফরিনাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল কর্মকর্তা যে তার বিয়ে কবে হয়েছে এবং বিয়ের পর পড়াশোনা কীভাবে করেছেন। উত্তর বেরিয়ে এলো এই যে, মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তার বিয়ে হয়, মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্টের পর তার পড়াশোনার স্পৃহা বেড়ে যায়, রাকিবকে কলেজে ভর্তি করানোর জন্য বললে সে রাজি হয় না, তাই সে বাবার বাড়িতে চলে যায় এবং একটি কলেজে ভর্তি হয়। সেখানেই তার পড়াশোনা চলে এবং পড়াশোনার খরচ তার পিতা বহন করেন। এরপর রাকিব তাকে কলেজ বন্ধ করে তার সঙ্গে সংসার করতে বলে, তাই সে স্বামীর সঙ্গে স্বামীর ঘরে ফেরত যায় না।

তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, কলেজে মাসে মাসে কেমন খরচ হয়? বইপত্র, যাওয়া-আসার ভাড়াসহ মাসে ৩০০-৪০০ টাকা খরচ হয় বলে উত্তর পেলাম। রাকিব তো শুনেই বলল যে, এই টাকা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না, এই টাকা দিতে হলে সে স্ত্রীকে পড়াবে না। এই বিষয়ে কি করা যায় প্রশ্নটি উপস্থিত সকলের দিকে ছঁড়ে মারলেন জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা। কেউ কিছু বলল না। শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষগণ আমাকে এর একটা সুষ্ঠু সমাধান দেওয়ার জন্য বলেন।

সে প্রেক্ষিতে প্রতিপক্ষগণকে প্রস্তাব দেওয়া হলো, যেহেতু বিয়ের সময় এই বিষয়ে আপনারা কথা বলে নেননি এবং করোনার জন্য রাকিবের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ সেহেতু আপনার মেয়ের কলেজের খরচ আপনারা আপাতত বহন করে নেন। প্রতিপক্ষগণ রাজি হলেন। তারা বললেন, যদি রাকিব আফরিনার লেখাপড়ায় কোনো বাধা না দেয় এবং আফরিনাকে এই বিষয় নিয়ে কোনো মানসিক অত্যাচার না করে তবে কলেজের খরচ তার বিনা দ্বিধায় দেবেন। ব্যাস হয়ে গেল সমস্যার সমাধান। কিন্তু শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না। এবার রাকিবের দাবি সে সন্তান চায় এখনই।

তাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চলল, লোকে বিভিন্ন কথা বলে, তাই সে এখনই সন্তান চায়। আফরিনা এখন সন্তান নিতে রাজি নন, তার কথা সে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর সন্তান নিতে প্রস্তুত। এবার আফরিনার কাছে তার বয়স জানতে চাইল লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা।  তার বয়স উনিশ চলছে। শুরু হলো রাকিবকে আরেক দফা বোঝানোর পালা। বিশ বছরের আগে বাচ্চা গ্রহণ একজন নারীর শরীরের এবং গর্ভের শিশুর জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা বোঝালাম। একজন শিক্ষিত মা একটা সন্তানকে কত সুন্দর ও সুগঠিতভাবে লালন-পালন করতে পারে এসব সহ অন্যান্য নানা কথা বোঝানোর পর আবারও রাকিবকে বোঝাতে সফল হলো ওই কর্মকর্তা।

এবার উভয়পক্ষই খুশি কারণ তাদের যে সমস্ত শর্তগুলো ছিল তা পূরণ হয়েছে এবং সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়েছে। প্রতিপক্ষগণ তার জামাই অর্থাৎ রাকিবকে খুশি মনে মেনে নিলেন এবং বাসায় দাওয়াত দিলেন যাতে সে এসে আফরিনাকে বাড়ি নিয়ে যায়। স্বামীও খুশি মনে রাজি হলেন। এভাবেই একটা জটিল সমস্যার সমাধান খুব সহজেই মাত্র একটি মীমাংসা সভায় ৩ ঘণ্টা সুষ্ঠু আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন হলো। এর প্রাপ্তিও বিশাল- সবার মুখে সুবিস্তৃত তৃপ্তির হাসি এবং আমার মনে এক অন্যরকম আনন্দ ও সন্তুষ্টি।  
আসাদ আলীর গল্প ॥ রাঙ্গামাটির পার্বত্য জেলা কাউখালী উপজেলার আসাদ আলী লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। আসাদ আলীর গল্প এমনই। আসাদ আলী, বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। গত ১০-১৫ বছর ধরে তার বেদখল হওয়া জমি ফিরে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে আসছিলেন। এজন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ নানা সরকারি অফিসে গিয়েও তিনি কোনো প্রতিকার পান নাই। সর্বশেষ রাঙ্গামাটির লিগ্যাল এইড অফিসার তার উপজেলায়  ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা ও আপোসে বিরোধ মীমাংসার বিষয়ে ইমাম খতিবদের সঙ্গে মতবিনিময় ও প্রচারসভা করলে আসাদ আলী লিগ্যাল এইড সম্পর্কে জানতে পেরে লিগ্যাল এইড অফিসে আসে। হতদরিদ্র আসাদ আলী একইসঙ্গে নিরক্ষর হওয়ার সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা তার রেকর্ডীয় জমি হতে তাকে দুইবার উচ্ছেদ করে।

লিগ্যাল এইড অফিসার অপর পক্ষকে নোটিস করলে তারা হাজির হলে আসাদ আলীর আহাজারি আরও বেড়ে যায়। কারণ অপরপক্ষ ধনী ও শিক্ষিত, সব কথা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলছিল। ফলে আসাদ আলীর মনে ভয় হচ্ছিল- আমি তো গুছিয়ে কিছুই বলতে পারছি না!!! স্যার তো ওদের কথাই শুনছে!!! আসাদ আলী বার বার একই কথা বলছিল- স্যার, আপনি একবার জমিতে এসে দেখেন। আপনার সব সিদ্ধান্ত  মানব। আমি মূর্খ মানুষ, সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারছি না।
আসাদ আলীর চোখের পানি আর অন্যদিকে নালিশি জমিতে কীভাবে যাব এই চিন্তায় মনে কষ্ট জমছিল। শেষ পর্যন্ত  একটা তারিখ দিয়ে বললাম- আমি যাব আপনার জমিতে।  গিয়ে দেখি, আসাদ আলীর বক্তব্য সত্য। দাগ মিলে না দাবি করে তাকে তার দখলীয় জমি হতে ২ বার উচ্ছেদ করা হয়েছে। স্থানীয় ভূমি অফিসের এক সার্ভেয়ার তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে একই জমি ২ বার বিক্রি করেছে। যাওয়ার সময় সার্ভেয়ার নিয়ে গেছিলাম। সার্ভে করে দেখা যায়  স্থানীয় ইফসুফের কাছ থেকে  আসাদ আলী ২০ শতক জমি পাবে। সার্ভেয়ার কাছ থেকে জমির ক্ষতিপূরণও পাবে। শেষ পর্যন্ত টানা ছয় মাস চেষ্টা করে আসাদ আলী ২০ শতক জমি, ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। দরিদ্র ভ্যানচালক আসাদ আলীর জমি ফিরে পাওয়ার গল্প।
পূর্ণিমা বেগমের গল্প ॥ এটিও মানিকগঞ্জের ঘটনা।  অভিযোগকারী পূর্ণিমা বেগম (৭০), তার দুই পুত্র সন্তানের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন যে, তার স্বামী অর্থাৎ প্রতিপক্ষদের পিতা মৃত্যুবরণ করলে তাকে এবং তার কন্যাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার উপক্রম করছেন। তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন এবং তাদের ওয়ারিশ মূলে প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। অভিযোগকারীর স্বামীর বাড়ি এবং ফসলি জমি মিলিয়ে সর্বমোট ৫০ শতাংশ ভূমি রয়েছে। ওই ৫০ শতাংশ ভূমি হতে অভিযোগকারী ওয়ারিশ হিসেবে ৬.২৫ শতাংশ এবং তার কন্যা ৮.৭৫ এবং দুই পুত্র প্রত্যেকে ১৭.৫ শতাংশ ভূমি প্রাপ্য হবেন।

অভিযোগকারী স্থানীয়ভাবে বিরোধটি সমাধান করতে চাইলেও প্রতিপক্ষগণ কোনো আগ্রহ প্রকাশ না করায় পরবর্তীতে তিনি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের দ্বারস্থ হন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের পরামর্শ অনুযায়ী অভিযোগকারী এবং তার কন্যার প্রাপ্য সম্পত্তি আপোস-মীমাংসার মাধ্যমে বুঝে পাওয়ার জন্য অত্র অফিসে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগকারীর প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে বিরোধটি মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য প্রতিপক্ষ মো. আক্তার হোসেন এবং কুদ্দুস মাহমুদকে অত্র কার্যালয়ে হাজির হওয়ার জন্য নোটিস প্রেরণ করা হয়।

ওই নোটিস প্রতিপক্ষগণ প্রাপ্তির পর নির্ধারিত তারিখে অভিযোগকারী এবং প্রতিপক্ষ উভয়ই হাজির হয়। দীর্ঘ সময় ব্যয় করে প্রতিপক্ষদের তাদের মাতার ও বোনের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করা হলে প্রতিপক্ষগণ তাদের ভুল বুঝতে পেরে বিরোধটি মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ওই প্রতিপক্ষগণ তার মাতা ও বোনের প্রাপ্য অংশ আপোসে বুঝিয়ে দিতে সম্মত হন এবং তাদের ভরণ পোষণের সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অভিযোগকারী এবং প্রতিপক্ষগণ বর্তমানে তাদের প্রাপ্য অংশে মিলেমিশে একত্রে বসবাস করছেন।  
মঙ্গারাম তঞ্চগ্যার গল্প ॥ বসত ঘরে চুরির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাঙ্গামটির বিলইছড়ির তরুণ মঙ্গারাম তঞ্চগ্যা। ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর স্থানীয় অংলা মার্মার বসত ঘরে চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর আসামি দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। পারিবারের লোকজনও কোনো খোঁজখবর নেননি। এদিকে আসামি গঙ্গারামের পক্ষে কোনো আইনজীবীও ছিল না।  আইনজীবী না থাকায় জামিন শুনানি ও জেরা করার সময় আইনজীবী না থাকায় বিাচরিক কার্যক্রম থমকে যায়।

রাঙ্গামাটি জেলা কারাগারে গণশুনানিতে গেলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে কারাগারের জেলার বিষয়টি জানান। পরবর্তীতৈ জেলা লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে তিনি আইনজীবী পান। আসামির আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মঙ্গারামকে জামিন দেন। বর্তমানে জামিনে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন গঙ্গারাম তঞ্চগ্যা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা লিগ্যাল এডি অফিসার মো. জুনাইদ বলেন , সরকারি খরচে বিনামূল্যের আইনগত সেবা দেওয়ার জন্য আমরা রাঙ্গামািটি জেলা কারাগারে প্রতি তিন মাস পর পর প্যানেল আইনজীবী ও কারাবন্দিদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বয় সভা করি। এর ফলে কারাগারে বিনাবিচারে আটক কারাবিন্দরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হচ্ছে এবং তাদের সমস্যার কথা সরাসারি লিগ্যাল এইড অফিসারকে বলার সুযোগ পাচ্ছে। 
গফুরের বদলে যাওয়ার গল্প ॥ দারিদ্র্যতার শিকলে বাঁধা একজন মানুষের নাম আব্দুল গফুর। পরিবারের চার সদস্যের মুখে ভাত তুলে দিতে রিক্সা নিয়ে নামেন রাস্তায়। জরাজীর্ণ শরীরে রিক্সা চালিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে অল্প উপার্জন করে কোনোভাবে সংসারের ঘানি টানতে থাকেন। তারপরও ভালোই চলছিল তাদের। কিন্তু চলার পথে এক পরিচিত যাত্রীর অসৎসঙ্গে পড়েন তিনি। কষ্ট আর পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ভুলে থাকার ভুল আশ^াসে ধীরে ধীরে গাঁজা সেবনে আসক্ত হতে থাকেন।

এভাবে চলতে থাকলে তার অসচ্ছল আয়ের একটি অংশ অপচয় হতে থাকে। এ নিয়ে  তার পরিবারেও শুরু হয় অশান্তি। কিন্তু গাঁজা যেন গফুরের পিছু ছাড়ে না। ঘরে বাইরে দুঃখের মধ্যেও গাঁজা তার সঙ্গী হয়ে উঠে। নিজেকে এক ভিন্ন জগতের রাজা ভাবতে থাকে গফুর। এমন সমংে ২০২২ সালে ১২ মে ঝিকরগাছা থানা পুলিশের তাতে আটক হয়ে যান গফুর। উদ্ধার হয় ১১৫ গ্রাম গাঁজা। তার বিরুদ্ধে গাঁজা রাখার অভিযোগে ঝিকরগাছা থানায় একটি মামলাও (মামলা নং৭ তাং১৩/৫/২০২২) জিআর মামলা নং৯০/২২।

আটকের পর চালান দিলে আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু এরপর হয় আরেক বিপত্তি ও বিড়ম্বনা। দিনের পর দিন মাসের পর মাস কেটে গেলেও গফুরের পক্ষে আদালতে কোনো জামিনে আবেদন পড়ে না। অর্থকষ্টের কারণে অভিমানি পরিবারও গফুরের প্েক্ষ আদালতে কোনো আইনি ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই মাত্র কয়েক দিনের মাথায় জামিন পাওয়ার অধিকারী হলেও কেউ তার পাশে না থাকার কারণে তাকে জেলহাজতেই পাহাড় সমান অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে সময় পার কতে হয়। এরপর জেল পরিদর্শনে বিষয়টি চোখে পড়লে সরকারি লিগ্যাল এইড অফিস অসহায় গফুরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

তাকে বিনামুল্যে সকল ধরনের আইনগত সহায়তা প্রদানের আশ^াস দেন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সিনিয়র সহকারী জজ রাফিয়া সুলতানা বিশেষভাবে মামলাটির তদারিক করেন। তার আশ্বাসে কাজ শুরু হয়ে যায়। লিগ্যাল এইড অফিস থেকে একজন প্যানেল আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয় গফুরের মামলাটি পারিচালনার জন্য। অবশেষে ২০২২ সালের ২২ আগস্ট গফুর জামিনে মুক্তি পান। দীর্ঘদিন পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরতে পেরে এক বুক ফাটা আনন্দে কেঁদে ফেলেন।

অন্ধকার ভবিষ্যৎ থেকে আলোর দেখা পেয়ে নিজেকে শুধরে নিতে চান গফুর। নতুন এক জীবনের স্বপ্নের আশায় আবার রিক্সা নিয়ে রাস্তায় নামেন গফুর। তার কিছুদিন আগে গফুরের সঙ্গে এই গফুরের কোনো মিল নেই। একবারে বদলে গেছেন তিনি। কর্ম আর পরিবারকে নিয়ে এগিয়ে চলাই এখন যশোরের ঝিকরগাছার উপজেলার নাভারন পূর্বপাড়ার মৃত আকবর আলীর ছেলে গফুরের প্রধান ব্রত। 
মিম পেল পিতৃ পরিচয় ॥ একটি পরিবারের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে সন্তানের ভবিষ্যৎও জড়িত। হালিমা সুলতানা একজন স্কুল শিক্ষিকা। পারিবারিকভাবে একজন সরকারি চাকরিজীবী মো. রফিকুল ইসলাম (বাচ্চু) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছরে মধ্যে তাাদের ঘর আলো করে আসে একটি কন্যাসন্তান। নাম রাখা হয় মোছা. মরিয়ম সুলতানা (মিম)। বাবা-মায়ের আদরে বাড়তে থাকে মিম। এরই মধ্যে স্বামী স্ত্রীর হঠাৎ দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক সময়ে পৃথক পৃথকভাবে থাকতে শুরু করে তারা। অসহতায় মিম বাবার আদর হতে বঞ্চিত হয়। স্বামী কোনো যোগাযোগ করে না।

কোথায়ও কোনো সমাধান না পেযে হালিমা সুলতানা জেলা জজ আদালত মামলা করার উদ্দেশ্যে আসেন। জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে লোক মুখে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রমের কথা শুনে তিনি সাতক্ষীরা চিফ জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত ভবনে লিগ্যাল এইড অফিসে আসেন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সালমা আক্তার হালিমার কথা শুনে তাকে তার সন্তানের পিতৃপরিচয় পাবার জন্য এডিআরের মাথ্যমে আপোস-মীমাংসার করা পরামর্শ দেন।

 দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মধ্যস্থাতায় প্রতিপক্ষ মো. রফিকুল ইসলাম (বাচ্চু ) নাবালিকা মরিয়ম সুলতানা (মিম) কে তার ওরশজাত সন্তান হিেিস  স্বীকৃতি প্রদান করেন। জেলা লিগ্যাল এইড মাধ্যমে বিনা খরচায় আপোস-মীমাংসার মাধ্যমে হালিমা সুলতানা তার সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।

×