ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রিপোর্ট গ্রহণকালে প্রধান উপদেষ্টা

গুম সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ৪ জুন ২০২৫

গুম সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘গুম সংক্রান্ত প্রতিবেদন ওয়েবসাইট ও বই আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি ঘিরে শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিকভাবেও আগ্রহ রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় ইন্টেরিম রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কী ভয়াবহ একেকটি ঘটনা! আমাদের সমাজের ‘ভদ্রলোকেরা’, আমাদেরই আত্মীয়-পরিজনরা ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। আপনারা যা যা কিছু পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে একটি হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত। গা শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। এই ধরনের বন্দিশালা কেমন হয়, তিন ফিট বাই তিন ফিট খুপরির মধ্যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আটকে থাকার যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার চিত্র মানুষের কাছে তুলে ধরা উচিত।’
বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশন প্রধান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। সদস্যদের মধ্যে নূর খান, সাজ্জাদ হোসেন এবং নাবিলা ইদ্রিস উপস্থিত ছিলেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া বার্তায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। 
প্রধান উপদেষ্টা কমিশন সদস্যদের কাছে প্রতিবেদনের আশু করণীয়গুলো চিহ্নিত করে কোন্টি কোন্ মন্ত্রণালয়ের আওতায় পড়ছে তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার নির্দেশনা দেন, যাতে করে সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজগুলো শুরু করতে পারে।
একজন কমিশন সদস্য প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘ঘটনাগুলো এতটাই ভয়াবহ যে, জড়িত অনেক কর্মকর্তা ও অন্যরাও অনুশোচনায় ভোগেন। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আত্মশুদ্ধির একটা প্রচেষ্টা হিসেবে। দুজন অফিসার লিখিতভাবে এর থেকে পরিত্রাণ চেয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। চিঠিগুলো গণভবনে পাওয়া গেছে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জনসম্মুখে এই চিঠির কথা স্বীকারও করেছেন।’
কমিশন সদস্যরা জানান, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে এবং তার মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাইবাছাই শেষ হয়েছে। কমিশন সদস্যরা আরও জানান, অভিযোগের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো তিন শতাধিক ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। 
নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার যাতে অন্তত ব্যাংক হিসেবে লেনদেন করতে পাওে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানান কমিশন প্রধান। তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনে কেউ সাত বছর নিখোঁজ থাকলে তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইন সংশোধন করে এটিকে পাঁচ বছর করার সুপারিশ করেন তিনি।
অতিদ্রুত যাতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে করণীয় জানাতে কমিশনকে পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 
কমিশন সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা ভয়ভীতি, নানান রকম হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে কাজ করে যাচ্ছেন। এ দেশের মানুষের জন্য আপনারা অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। ভবিষ্যতে যারা মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করবে, আপনারা তাদের অনুপ্রেরণা।’
বিকেলে বেইলী রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ব্রিফিংকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, 
‘এর আগে আপনারা জানতেন গুম সংক্রান্ত কমিশনে ১ হাজার ৭৭০টার মতো কমপ্লেইন (অভিযোগ) ছিল। এটা আসলে ১ হাজার ৮৫০টা। গতকাল পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে। যারা অভিযোগ করছেন, তারা কমিশনের কাছে ইন্টারভিউ (সাক্ষাৎকার) দিয়েছেন। ভিক্টিমদের (ভুক্তভোগী) সিকিউরিটির (নিরাপত্তার) কারণে অনেক চ্যাপ্টার (অধ্যায়) আমরা দিতে পারব না। ৭টা চ্যাপ্টার আমরা আপনাদের দেব। আজকের ইন্টেরিম রিপোর্টে (অন্তর্বর্তী  প্রতিবেদন) মূলত ছিল, টর্চার (নির্যাতন) কীভাবে হয় এবং কারা অংশ নিয়েছে। মূল কালপ্রিট (অপরাধী) ছিল র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং (গোয়েন্দা শাখা)। যারা গুম হয়েছেন, ভিক্টিম, তাদের ভাষ্যে কিলার ফোর্স (হত্যাকারী বাহিনী)।’
প্রেস সচিব বলেন, ‘আর একটি বড় ফাইন্ডিংস হচ্ছে, যারা এগুলো করেছেন, তারা কেন এইগুলোতে যুক্ত হলেন। দেখা যাচ্ছে, পুলিশের যারা করেছেন, বিপিএম, পিপিএম পাওয়ার জন্য, ভালো পোস্টিংয়ের জন্য করছেন। তারা প্রলুব্ধ হয়েছেন এগুলো করতে। যে লোকগুলো করছে, তারা আমাদের আশপাশেরই লোক। হয়তো কাউকে কাউকে আমরা হ্যাপি বার্থডেও জানাচ্ছি। 
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সবাইকে এগুলো জানাতে। এটা বাংলাদেশের বিষয় না, গ্লোবাল ইস্যু। এটা পৃথিবীর সবাইকে জানানো উচিত। এখনও মিসিং রয়েছেন ৩০০ জন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তারা কোথায় আছেন, জীবিত আছেন না মৃত, এই বিষয়টা জানতে হবে। তারা আমাদের ভাই, আমাদের বোন, এরা কোথায় গেল, এটা বের করা পর্যন্ত কাজ করতে হবে।’ শফিকুল আলম বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা সব শুনে বলেছেন, এই বিষয়ে একটা হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত। বাংলাদেশে যে ইনফোর্সড ডিসয়েপেরন্স (জোরপূর্বক গুম) ঘটনা ঘটেছে, সবার জন্য ভয়াবহ বিষয়। আপনারা জানেন, গণভবনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যে একটা মিউজিয়াম করা হচ্ছে, তার একটি অংশ থাকবে, এই ভিকটিমদের ওপর কীভাবে অত্যাচার করা হয়েছে।

×