ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম

২০০ কোটি টাকা বাণিজ্যের আশা বাজারজাতের অপেক্ষায় দিন গুনছে বিক্রেতারা

তাহমিন হক ববী /আব্দুস সালাম

প্রকাশিত: ০০:৩০, ২ জুন ২০২৫

২০০ কোটি টাকা বাণিজ্যের আশা বাজারজাতের অপেক্ষায় দিন গুনছে বিক্রেতারা

.

সুস্বাদু ফলের  মৌসুম হচ্ছে  গ্রীষ্ম। জ্যৈষ্ঠ মাস চলছে। আম, জাম, লিচু, জামরুলসহ মৌসুমি ফলগুলো পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব ফল সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আম, লিচু এখন পাড়া-মহল্লা, গ্রামে-গঞ্জে বিক্রি হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা ফলের ঝুড়ি সাজিয়ে বসেছেন। বিক্রেতাদের দাবি, ফলে ফরমালিন নেই। আর এবার উৎপাদনও ভালো, তাই দামও গতবারের তুলনায় বাড়েনি।
তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন জেলার আমের ভিড়ে ক্রেতারা খুঁজতে শুরু করেছে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় জিআই পণ্য স্বীকৃত সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আম। জাতটি দিয়ে দেশে ও বিদেশের আমের বাজারে নাম লিখিয়েছে  হাঁড়িভাঙ্গা। খুব দ্রুতই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় আমের এই প্রজাতিটি চলতি বছরে এখনো পুরোপুরি পুষ্ট হয়নি। তার আগেই  দেশে ও বিদেশে ৫০ কোটি টাকার আম রপ্তানির ক্রয়াদেশ পেয়েছেন বাগান মালিকেরা। আরও অর্ডার পাওয়ার আশা করছেন তারা।
তবে হাঁড়িভাঙ্গার মতো দেখতে এমন আম অনেক বিক্রেতা হাঁড়িভাঙ্গা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ বলছে, এবার নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে আসছে না হাঁড়িভাঙ্গা। হাঁড়িভাঙ্গার আনুষ্ঠানিকতা এবার দুই সপ্তাহ পেছাতে পারে। কারণ গাছে আমের মুকুল এক মাস দেরিতে এসেছে। ডিসেম্বরের শেষে জানুয়ারি প্রথম দিকে সাধারণত আমের মুকুল দেখা গেলেও এবার হাঁড়িভাঙ্গা আমের মুকুল এসেছে ফেব্রুয়ারিতে। বর্তমানে আমের বয়স প্রায় চার মাস। প্রতি বছর হাঁড়িভাঙ্গা আম জুনের ২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত শুরু হতো। কিন্তু এবার তা দেড় থেকে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে যাবে।
আম চাষিরা বলছেন, জুনের শেষ নয়তো জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাজারে মিলবে পরিপক্ব হাঁড়িভাঙ্গা আম। এর আগে বাজারে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাওয়া গেলেও তা হবে অপরিপক্ব।
হাঁড়িভাঙ্গার প্রকৃত স্বাদ পেতে এবার একটু অপেক্ষায় থাকতে হবে। বর্তমানে বাগানগুলোতে আমের পরিচর্যা চলছে। এক্ষেত্রেও কৃষি অফিস বলছে, আবহাওয়া তপ্ত থাকলে এর আগেও গাছ থেকে আম পাড়া যেতে পারে। পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে চাষিরা আম ঘরে তুলতে পারেন। এবার কিছুটা ব্যতিক্রম হয়েছে। দেরিতে মুকুল আসায় ফলও দেরিতে আসবে।
বিষমুক্ত ও অতি সুমিষ্ট আঁশহীন হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।  বেশ  কয়েক বছর ধরে ফলন ভালো হওয়ায় বেড়ে চলেছে আম উৎপাদনের পরিধিও। রংপুর সদর, মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলা থেকে নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত বাগানে বাগানে শোভা পাচ্ছে হাঁড়িভাঙ্গা।  এবার রংপুরে বিভিন্ন জাতের আমের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ৩৫৯ হেক্টর। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙ্গা আম এক হাজার ৯১০ হেক্টরের বেশি জমিতে চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে হাঁড়িভাঙা আম প্রায় ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন ফলন হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে অন্তত দুইশ’ কোটি টাকার ওপরে হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
বলা যায়, এ অঞ্চলের গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে হাঁড়িভাঙ্গা আম। বাসিন্দারা জানান, আট থেকে ১০ বছর আগেও এসব এলাকা ছিল চরম দারিদ্র্যপীড়িত। মানুষ তিন বেলা দূরে থাক এক বেলার খাবারও জোটাতে পারত না। মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৮ মাস পতিত পড়ে থাকে। হাঁড়িভাঙ্গা আম তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে। এখন ধানের বদলে ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে
তুলেছেন তারা। বছরে উৎপাদিত আম বিক্রি করে সচ্ছলতা ফিরেছে তাদের সংসারে। বাগান মালিক সোলায়মান আলী জানান, ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন আড়তদার এবার অগ্রিম টাকা দিয়েছেন। তার মতো আরও অন্তত ৬০টি বাগান মালিকের সঙ্গে আড়তদাররা চুক্তি করেছেন। মোট ৫০ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ পেয়েছেন তারা।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে আম রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এ মৌসুমে তিন দফায় ঝড় হওয়ায় ফলনে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে শঙ্কা করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক ঝড়ের পূর্বাভাস নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে আমচাষিদের মধ্যে। আমচাষি বেলাল হোসেন বলেন, এবার গাছে আমের মুকুল এক মাস দেরিতে এসেছে। মুকুল আসার পর থেকে তিনবার ঝড় হয়েছে। এর ফলে আমের ফলন গতবারের তুলনায় কম হয়েছে। আম পাড়ার আর দেড় মাস সময় বাকি। যদি ফের বড় ধরনের ঝড়-বৃষ্টি হয় তাহলে আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ব।
ভালো মানের হাঁঁড়িভাঙ্গা আম চেনার উপায় প্রসঙ্গে বাগান মালিক আমজাদ হোসেন বলেন, হাঁড়িভাঙ্গা আমের ওপরটা যত কালচে ভেতরে ততই সুন্দর। এর স্বাদ ও ঘ্রাণ   লোভনীয়। দেখতে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন আমে কীটনাশক ও ¯েপ্র ব্যবহার বাগান কিনে নেওয়া ব্যবসায়ীরা নিজেদের লাভের জন্য করে থাকেন। এতে আম দেখতে ভালো, সুন্দর ও পাকা রঙের মনে হয়। হাঁড়িভাঙ্গা আমের বৈশিষ্ট্য হলো এটি আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। এই আমের আঁটিও খুব ছোট। ছাল পাতলা। প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। মৌসুমের শুরুতে হাঁড়িভাঙ্গার চাহিদা বেশি থাকায় এর দাম কিছুটা বেশি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে প্রতি কেজি হাঁড়িভাঙ্গা আকারভেদে ৬০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে পারে।
এই আমের ইতিহাস বলছে, হাঁড়িভাঙ্গা আমের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার নামে এক বৃক্ষবিলাসী। স্বাধীনতার আগের বছর ১৯৭০ সালে শতায়ু নফল উদ্দিন পাইকার মারা যান। এখন তার লাগানো হাঁড়িভাঙ্গা গাছটির বয়স ৭৬ বছর। নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন জানান, সম্ভবত ১৯৪৯ সাল, তখন তার বাবা নফল উদ্দিন এই গাছটি রোপণ করেছিলেন। উপজেলার বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তার বাবা। তবে একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি (ফিল্টার সিস্টেমে) দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। তিনি আরও জানান, গাছটিতে এক সময় বেশ সংখ্যক  আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম স¤পর্কে জানতে চায়। তখন থেকেই গাছটি হাঁড়িভাঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। এখন হাঁড়িভাঙ্গা আমের সুনাম মানুষের মুখে মুখে। গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাগান। তিনি হাঁড়িভাঙ্গা আমের মাতৃগাছটির সংরক্ষণের দাবি জানান।
১৯৯২ সাল থেকে হাঁড়িভাঙ্গা আমের সম্প্রসারণ শুরু হয় আখিরাহাটের আব্দুস সালাম সরকারের হাত ধরে। শুধু চাষাবাদ নয়, এই অঞ্চলের হাঁড়িভাঙ্গা সম্প্রসারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার হাত ধরেই রংপুর অঞ্চলের মানুষ এখন অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভের আশায় উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে প্রতিবছর হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
আব্দুস সালাম সরকার বলেন, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ করছি। টেকসই অর্থনীতির জন্য হাঁড়িভাঙ্গা আমের সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের দাবি করে আসছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই দাবি উপেক্ষিত হলেও আমের উৎপাদন ও বাগান সম্প্রসারণ থেমে নেই। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙ্গাকে ঘিরে এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে।

 

প্যানেল

×