ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দুবাইয়ের স্টারবাকস কফিশপে গোপন বৈঠক হয় দুজনের

নূরের গোমর ফাঁস করলেন সাফাদি

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২২:৫১, ৯ জুলাই ২০২৩

নূরের গোমর ফাঁস করলেন সাফাদি

সাফাদির সঙ্গে নুরুল হক নূর

ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কথিত গোয়েন্দা কর্মকর্তা মেন্দি এন সাফাদি গণঅধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হক নূরের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরের সঙ্গে দুবাইয়ের স্টারবাকস কফিশপে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন ইসরাইলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদি। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্যাম্পেন নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনার সময়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ইসরাইলের সমর্থন চেয়েছেন নূর। মেন্দির আদর্শের সঙ্গে নূরের আদর্শের মিল আছে। নূর আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের দ্বার খুলে দেবে ইসরাইলের জন্য।

মেন্দি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ ফিলিস্তিনের প্রচারণায় বিশ্বাস করে এবং ইসরাইলের কথা শুনতে চায় না। নূর বোঝে ফিলিস্তিনের সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে ভূমি দখল করতে চায়। কারণে নূর ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপন করবে। সময় টিভির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে গণঅধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হক নূরের সঙ্গে একান্তে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করে এসব কথা তুলে ধরেন ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কথিত এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদি। তিনি জানিয়েছেন, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর বেলা তিনটায় বৈঠক শুরু হয় দুবাইয়ের স্টারবাকস কফি শপে। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব আলোচনা হয়। বৈঠকে আমরা আবারও সাক্ষাতের জন্য একমত হই।

এদিকে কথিত মোসাদ কর্মকর্তা মেন্দি এন সাফাদির সাক্ষাৎকারটি প্রচার হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান দাবি করেন, ইসরাইলের নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে কাতার, দুবাই ভারতে তিন দফা বৈঠক করেছেন গণঅধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হক নূর।

ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরাইলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের কথিত গোয়েন্দা কর্মকর্তা মেন্দি এন সাফাদি এবারই আলোচনায় প্রথম নয়। এর আগেও আলোচনায় এসেছেন তিনি। প্রায় সাত বছর আগে ২০১৬ সালে মেন্দি এন সাফাদির নাম আলোচনায় আসে। তখন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে ভারতের আগ্রায় গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন মেন্দি এন সাফাদি। বৈঠকে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতে মেন্দি এন সাফাদির সহায়তা চেয়েছিলেন আসলাম চৌধুরী। শিপন কুমার বসু নামে এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় মেন্দির সঙ্গে আসলামের বৈঠক হয়। ওয়ার্ল্ড হিন্দু স্ট্রাগলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শিপন কুমার বসু। ভারতের আগ্রায় একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সে সময় মেন্দি ভারত সফর করছিলেন। মেন্দির সঙ্গে সাক্ষাতের খবর বের হওয়ার পর ওই বছরই আসলামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এক বছর পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। পরে তার বিরুদ্ধে দুদকের দুর্নীতি মামলাসহ একাধিক মামলা দায়ের করার পর গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রায় সাত বছর পর আবার মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নূরের বৈঠককে কেন্দ্র করে রাজনীতির অঙ্গন সরব। মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে নূর সাক্ষাৎ করেছেন কি না, তা নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। সাক্ষাতের খবর নাকচ করে দিয়ে নূর বলেছেন, সবই অপপ্রচার। গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মেন্দি এন সাফাদি বলেছেন, তার সঙ্গে নূরের সাক্ষাৎ হয়েছিল।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মেন্দি মোসাদের এজেন্ট, দেশটির ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সদস্য। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সমর্থক। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেন্দি এন সাফাদির রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ব্যাপক। সাফাদি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাসি, রিসার্চ, পাবলিক রিলেশনস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস প্রতিষ্ঠা করে তিনি বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তিনি সিরিয়ার বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বাহিনীকে সহযোগিতা স্বাধীন কুর্দিস্তানের পক্ষেও জনমত গঠনের কাজ করছেন। এমনকি তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় যুক্ত আছেন। কূটনৈতিক সম্পর্কের অংশ হিসেবে তিনি নিয়মিত ভারত, আজারবাইজান, ইউরোপ এশিয়ায় ভ্রমণ করেন। ২০১৫ সালের জুলাই ইসরাইলি সংবাদপত্র হারেৎজ লেবাননের সংবাদপত্র আল আখবারকে উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন ছাপে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদবিরোধী গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহে ভূমিকা রেখেছেন মেন্দি এন সাফাদি।

মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নূর গণমাধ্যমে বলেছেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। এই অভিযোগ এখনো কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে দলে ভাঙন ধরাতে, দলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ইসরাইলের কোনো নেতা কিংবা মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি এমন প্রমাণ দিতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব। এর আগেও আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এসেছিল তখনো আমি বলেছি এই কথা।

ঢাকায় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ইউসুফ সালেহ ওয়াই রামাদান সাংবাদিকদের বলেছেন, কাতারে ফুটবল খেলার (বিশ্বকাপ) সময় মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদ সদস্য সচিব নূরের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি প্রথমে আমাদের নজরে আসে। আমাদের গোয়েন্দা সূত্রগুলো এটা নিয়ে আগ্রহী হয় এবং (মেন্দি এন) সাফাদির সঙ্গে তার বৈঠকের কিছু ছবি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই আমরা এবং আমার মনে পড়ে, অন্য বৈঠকগুলো হয় দুবাই, কাতার ভারত- এই তিন জায়গায়। গত ২২ জুন ঢাকার ফিলিস্তিন দূতাবাসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোসাদের সঙ্গে নূরের বৈঠক নিয়ে দাবি করেন রাষ্ট্রদূত। রোহিঙ্গাদের জন্য ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির খাদ্য সহায়তা অবহিত করতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঢাকার ফিলিস্তিন দূতাবাস। ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘নূরের সঙ্গে কাতার, দুবাই ভারতে তিন দফা বৈঠক হয়েছে মোসাদের, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার ছবি পেয়েছি।

যদি তিনি (নূর) অস্বীকার করে থাকেন, সেটা ফিলিস্তিনের জন্য ভালো। তবে যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। রামাদান আরও বলেন, মোসাদ থেকে টাকা নেওয়া কখনো বাংলাদেশের মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, তিনি (নূর) যদি এটা অস্বীকার করেন, তাহলে আমার জন্য যথেষ্ট, একজন ফিলিস্তিনির জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য কি যথেষ্ট? কারণ, তিনি এর মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা যতটা নষ্ট করবেন, ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রেও তেমনটা করবেন। ইসরাইল থেকে টাকা নেওয়া মানুষ কখনো নেতা হতে পারে না মন্তব্য করে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত বলেন, তারা মোসাদের কাছে যা তুলে ধরতে চাইছে, তা কোনোভাবে বাংলাদেশের জনগণের উত্তম স্বার্থের জন্য নয়।

ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত অভিযোগ তোলার পর রাতে নূর ফেসবুকে এসে বলেন, এটা একেবারেইভিত্তিহীন, অবাস্তব, অসত্য

জাতীয় প্রেস ক্লাবে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বলেছেন, গত ১৮ জুন দলের আহ্বায়ক . রেজা কিবরিয়ার বিরুদ্ধে সদস্য সচিব নুরুল হক নূরের কিছু অভিযোগের প্রেক্ষিতে . রেজা কিবরিয়ার বাসার ছাদে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি সভা হয়। সেখানে নুরুল হক নূর দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে ইনসাফ কায়েম কমিটির একটি সভায় অংশ নেওয়া তাদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ তোলেন। এর জবাবে . রেজা কিবরিয়া ইনসাফ বাস্তবায়ন কমিটির সভায় যাওয়ার ব্যাখ্যা দেন।

তবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি মিথ্যা বলে দাবি করেন এবং প্রমাণ থাকলে তা হাজির করতে বলেন। একই সময়ে তিনি নুরুল হক নূরের বিরুদ্ধে কয়েকটি সুস্পষ্ট অভিযোগ আনেন। যার মধ্যে কথিত মোসাদের এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে আলোচিত বৈঠকের সত্যতা সংক্রান্ত কিছু তথ্য, আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে দলীয় তহবিল নিজে গ্রহণ এবং হিসেব না দেওয়া এবং শিপন বসুসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহভাজন লোকদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নুরুল হক নূর কাতারে ইসরাইলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে কোনো রকম আর্থিক সুবিধা গ্রহণের বিষয়ে অস্বীকার করেন। বৈঠকের কথা স্বীকার করলেও বৈঠকের আলোচ্য সূচি কী ছিল, তা তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অবগত করতে অস্বীকৃতি জানান।

প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সদস্য সচিব নুরুল হক নূর আবারও তার সঙ্গে মেন্দি এন সাফাদির কোনো বৈঠক হয়নি বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, যারা কার্যালয়ে যেতে পারে না, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই, তারাই গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মী দাবি করে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে বলে মন্তব্য করেছেন।

গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানান, গত ১৯ জুন নুরুল হক নূর দপ্তর সমন্বয়কের মাধ্যমে নোটিস দিয়ে আরেকটি সভা ডাকেন, যা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বৈধ নয়। ওই সভায় নুরুল হক নূর নিজেই সভাপতিত্ব করেন এবং ওই সভার শুরুতে সূচনা বক্তব্যে তিনি আবারও মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে  বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেন।

×