ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

ষড়ঋতুর দেশ থেকে দুই ঋতু উধাও হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ষড়ঋতুর দেশ থেকে দুই ঋতু উধাও হচ্ছে

শাহীন রহমান ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে আবহাওয়ার ওপর। ফলে ষড়ঋতুর এই দেশের আবহাওয়ার ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই পরিবর্তনের কারণে ষড়ঋতুর দেশে এখন দৃশ্যমান চারঋতু। বাকি দুই ঋতু ইতোমধ্যেই তার বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। অন্য চার ঋতুর আবহাওয়ার ধরন একই থাকছে না। একেক বছরের একের ধরনের আচরণ করছে। এবারের শীতের ধরনের মধ্যেই তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সঠিক সময়ে শীত সঠিক আচরণ করছে না। অসময়ে শীতের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। পৌষ ও মাঘ এখনে শীত ঋতু বলে পরিচিত। কিন্তু প্রতি বছর শীত ঋতু একই আচরণ করছে না। এ বছর পৌষে শীত ছিল না বললেই চলে। অথচ মাঘে এসে জাঁকিয়ে শীত শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই একেক বছরের শীত একেক ধরনের আচরণ করছে। সঠিক সময়ে শীত প্রকৃতিতে প্রবেশ করছে না। কোন বছর আগেই আসছে। আবার কোন বছর অনেক দেরিতে শীত আসছে। এবার অনেক দেরিতে শীত প্রবেশ করেছে। কিন্তু ভরা শীতে বিশেষ করে পৌষমাসে শীত অনেকটাই উধাও হয়ে যায়। তারা জানায় বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সাগর বেশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। সাগরের উষ্ণ বেড়ে যাওয়ায় শীতের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। এবারের শীতের আচরণনে তা স্পষ্ট হয়েছে। আবার প্রকৃতিতে শরত ও হেমন্ত নামে আলাদা ঋতু থাকলেও তা আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। বর্ষা ঋতু কোন কোন বছর পিছিয়ে যাচ্ছে। আবার কোন কোন বছর দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ছে। এ কারণে শরত ঋতু বর্ষার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। অপর দিকে কোন কোন বছর হেমন্তের আচরণ শীতের মতো হয়ে পড়ছে। ঋতু বৈচিত্র্যের ধরনের পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি থেকে এই দুই ঋতু এখন আলাদা করে চেনার উপায় থাকছে না। আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক মোঃ শাহ আলম বলছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার ধরনে বেশ একটা পরিবর্তন চলে এসেছে। একসময় পৌষ-মাঘ শীতের জন্য পরিচিত থাকলেও এখন সব বছরে সেরকম দেখা যায় না। গত দুই তিন বছর জানুয়ারি মাসে বেশ গরম পড়ছে। এ বছর আবার একটু ঠা-া পড়ছে। আবার কখনও ফেব্রুয়ারি থেকেই গরম পড়তে দেখা যায়। তিনি এবারের শীতের ধরন পরিবর্তনের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন কয়েকদিন তাপমাত্রা বেশি থাকার পরেও শীত বেশি অনুভূত হয়েছে। মূলত সেটা হয়েছে কুয়াশার কারণে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে একসময় ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও এখন দেখা যায় আসলে চারটি ঋতু হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে শীত ঋতুর ওপর। ফলে শীতও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছে না। হয়ে পড়ছে শৈত্যপ্রবাহ ও কুয়াশা নির্ভর। যখন শৈত্যপ্রবাহ থাকছে বা কুয়াশার বেশি মাত্রায় থাকছে তখনই শীত অনুভূত হচ্ছে। না থাকলেও শীতকে যেন চেনাই দায় হয়ে পড়ছে। আবার কখনও তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়। মনে হয় যেন প্রকৃতিতে গ্রীষ্ম এসে গেছে। গত জানুয়ারিতেই তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে চলে যায়। অথচ তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রীর ওপরে উঠে গেলে তাকে আর শীত বলা যায় না। কিন্তু এ বছরের পৌষে শীতের এমনও আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। তারা বলেন শুধু এ বছর নয় সম্প্রতি বছরগুলোতে শীত সঠিক আচরণ করছে না। অথচ ঋতু বৈচিত্র্যের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ঋতু প্রকৃতিতে হাজির হওয়ার আগে তার আগমনী বার্তা দিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার কথা। বিগত ১০ বছরের আবহাওয়ার ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শীত তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও বর্তমানে দৃশ্যত এখন আর ৬ ঋতুর দেখা পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতোমধ্যে ঋতুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কারও কারও মতে ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী ৩টি ঋতু আবার কারও মতে ৪টি ঋতুর অস্তিত্ব রয়েছে। কারও মতে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত ঋতুর অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। আবার কারও মতে হেমন্ত কাল যোগ হয়েছে। তিন অথবা চার ঋতু যাই হোক না কোন ঋতুর সংখ্যা যে কমে এসেছে আগের আর ৬টি ঋতুর সন্ধান যে পাওয়া যায় না তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে দিনদিন। ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন একটু বিশ্লেষণ করলে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে দেখা যায় শরত, হেমন্ত ঋতু হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি থেকে এই দুই ঋতু আলাদা করে দেখাতে পাওয়া যায় না। গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত ঋতুর মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে। শরতের আবহাওয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বর্ষার মতো। ঋতু বৈচিত্র্যে অনুযায়ী আষাঢ় শ্রাবণ বর্ষাকাল হলেও এসয়ে ঠিক মতো বর্ষা আসছে না। প্রায় আষাঢ় প্রায়ই বৃষ্টিহীন থাকছে। অপর দিকে শরতের আবহাওয়া এখন বর্ষার মতো হয়ে পড়ছে। আষাঢ় শ্রাবণের গরমে ও তাপমাত্রা বাড়ছে। আষাঢ় শুরু হওয়ার সময়ই মৌসুমি বায়ু প্রবেশের কথা থাকলেও এটি এখন আর সময় মতো আসছে না। দেরিতে আসার কারণে বৃষ্টিপাত দেরিতে শুরু হচ্ছে। ফলে বর্ষা শেষ হতে সময় লাগছে। আবহাওয়াবিদরা বলেন, বিশ্বজুড়েই চলছে আবহাওয়ার হেয়ালি আচরণ। ইউরোপ, আমেরিকা, আর্কটিক, অস্ট্রেলিয়া, চীন থেকে শুরু করে ভারত উপমহাদেশ সর্বত্র আবহাওয়ার হেয়ালি আচরণে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। প্রকৃতি ঘটাচ্ছে ছন্দপতন। তারা বলেন, প্রকৃতির নিয়ম ও মানুষের সৃষ্ট বহুবিধ কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে।
×