রশিদ মামুন ॥ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় আটকে যাচ্ছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিল আদায়। নিজেদের আর্থিক অসচ্ছলতার কথা বলে শিল্প মালিকরা বিল প্রদানের বিপরীতে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এতে করে আদালত প্রকৃত বিলের বদলে পরিশোধের জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বেঁধে দিচ্ছে। এতেই প্রতিমাসে শিল্প মালিকদের কাছে আটকে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব। তিতাস বলছে এখন এই অঙ্ক বাড়তে বাড়তে ৩৬৩ কোটিতে ঠেকেছে। এ খাতে গড়ে ৪৬ মাসের সমতুল্য বিল বকেয়া পড়েছে তিতাসের।
তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি সূত্র বলছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর তিন জেলাতেই এমন শিল্প রয়েছে। তবে এখনও ময়মনসিংহ জেলায় এমন কোন শিল্প পাওয়া যায়নি। তিতাসের বকেয়ার অন্যসব আদায় হলেও শঙ্কা রয়েছে এই বিল আদায় নিয়ে। তিতাস তার বিল আদায়ের মাসিক বিবরণীতে এই শিল্প কারখানাকে বলেছে নিষেধাজ্ঞাধীন শিল্প। প্রতিমাসে আদালতের নিষেধাজ্ঞায় দুই কোটি টাকা পর্যন্ত বিল আদায়ে বাধা দিচ্ছে।
তিতাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ধরা যাক কোন একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাসিক প্রকৃত বিল হয় ১৮ লাখ টাকা। কয়েক মাসের বিল ইচ্ছাকৃত বকেয়া পড়ার পর তিতাস কঠোর হতে গেলে শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা আদালতের দ্বারস্থ হন। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা আদালতের কাছে আর্জিতে বলছেন, তার প্রতিষ্ঠানে বহু শ্রমিক কাজ করেন। এখন গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে তার কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়বে। আদালত দেখা যাচ্ছে তখন ওই প্রতিষ্ঠানের ১৮ লাখ টাকা বিলের বদলে তাকে মাসে চার লাখ টাকা বিল প্রদানের সীমা বেঁধে দিচ্ছে। প্রতিমাসে তার ১৮ লাখ টাকার প্রকৃত বিলের বিপরীতে তিতাস ৪ লাখ টাকা আদায় করছে। বাকি ১৪ লাখ টাকা বকেয়া থেকে যাচ্ছে। এভাবে বকেয়ার অঙ্ক প্রতিমাসেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিতাস সূত্র বলছে বিষয়গুলো বিচারাধীন হওয়াতে কেউ এসব নিয়ে কথা বলতেও চান না। বিল আদায় করার উদ্যোগ হিসেবে কি করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিতাসের অন্য এক কর্মকর্তা জানান, আমরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে আপীল করছি। আপীলে কিছু অর্থ বাড়িয়ে বিল করার অনুমতি দিচ্ছে। আমরা তখন আবার আপীল করছি। তিনি বলেন, এ ধরনের ১ হাজার ৪০০টির মতো মামলা রয়েছে। একদিকে বিল তো আদায়ই হচ্ছে না অন্যদিকে মামলা পরিচালনার জন্য তিতাসের অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন এক্ষেত্রে যে কোম্পানির বিল এভাবে আটকে যাচ্ছে সেই কোম্পানিও আদালতের কাছে পৃথকভাবে তার সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারেন। তিতাসও তার সমস্যার কথা আদালতকে জানাতে পারে। যেখানে তিতাসের ঘাটতি রয়েছে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।
তিতাস বলছে আগে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাসের বিল বকেয়া রাখা যেত। তবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজি আমদানির পর থেকে এখন আর বিল বকেয়া রাখা যায় না। তিতাস নগদ অর্থে গ্যাস ক্রয় করে বাকিতে বিক্রি করছে। এতে করে আর্থিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিদ্যুত এবং গ্যাসের সমস্যা সমাধানে বৈঠক করেছে বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, বিদ্যুত, জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ছাড়াও বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের কাছে বিল আদায়ে সহায়তা চায় সরকার। ব্যবসায়ীরা সরকারকে বিল আদায়ে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে বৈঠকের পর নসরুল হামিদ বিপু জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীরা বলছেন তারা বিল আদায়ে আমাদের সহযোগিতা করবেন।
তিতাস গ্যাস বিরতণ কোম্পানি সূত্র বলছে, ৩৬৩ কোটি টাকা বকেয়ার মধ্যে সব থেকে বেশি বকেয়া পড়ে আছে নারায়ণগঞ্জের উদ্যোক্তাদের কাছে। জেলার শিল্প মালিকদের কাছে ২৪৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। জেলাটিতে এ খাতের বিলের ৫৪ দশমিক ৬৭ মাসের সমপরিমাণ বিল অনাদায়ী রয়েছে। এরপরই রয়েছে গাজীপুরের উদ্যোক্তাদের কাছে। সেখানে বকেয়ার পরিমাণ ১০৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। জেলায় এ ধরনের শিল্প মালিকদের কাছে ৩৯ দশমিক ২৬ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। বাকি অর্থ জমে আছে ঢাকাতে। তবে ঢাকায় জমে থাকা টাকার পরিমাণ ১২ কোটি ৪৩ লাখ। সব মিলেয়ে ১৮ মাসের সমতুল্য বকেয়া রয়েছে।
তিতাসের নারায়ণগঞ্জ এলাকার এক কর্মকর্তা জানান, বিল আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে যারাই উচ্চ আদালতে যায় তাদের বিষয়টি দেখার জন্য আমরা তিতাসের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করি। এসব বিষয় তিতাসের প্রধান কার্যালয় থেকে দেখা হয়।
এ বিষয়ে একই ধরনের কথা বলছেন তিতাসের গাজীপুর অঞ্চলের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো প্রধান কার্যালয় দেখছে। যেহেতু বিষয়গুলো বিচারাধীন। তাই আমরা আদালতের নির্দেশ মতো কাজ করছি। এর বাইরে আমাদের যাওয়ার সুযোগ নেই।
সূত্র বলছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন প্রণয়ের পর সেখানে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে অনেক মামলা বিইআরসিতে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়। আবার কোন কোন মামলা উচ্চ আদালত আমলে নিতেও পারে।
তিতাস বলছে নিষেধাজ্ঞাধীন শিল্পের বিপরীতে সাধারণ শিল্প যারা বিল আদায়ে কোন বাধার সৃষ্টি করে না তাদের বিল আদায়ের শতকারা হার ১০০ ভাগ। অর্থাৎ যারা গ্যাস ব্যবহার করছেন তারা সবাই বিল দিচ্ছে। গত জুলাই মাসে দেখা যায় তিতাসে নিষেধাজ্ঞাবিহীন শিল্প মালিকরা ২৩০ কোটি ৬০ লাখ টাকার গ্যাস ব্যবহার করেছেন। এর বিপরীতে তারা বিল দিয়েছে ২৩০ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যবহারের চেয়ে ৩০ লাখ টাকা বেশি বিল আদায় করেছে।