ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও জেলা এবং বিভাগকেন্দ্রিক

প্রচলিত নীতিমালাই সরকারী স্বাস্থ্যসেবার অন্তরায়

প্রকাশিত: ১০:১০, ৮ জুন ২০১৯

 প্রচলিত নীতিমালাই সরকারী স্বাস্থ্যসেবার অন্তরায়

নিখিল মানখিন ॥ সরকারী স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর দক্ষ ও ফলপ্রসূ ব্যবহারের অন্যতম প্রতিবন্ধক হচ্ছে ‘কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’। এমন অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়, সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত এবং সংস্কার করার জন্যে প্রচলিত সরকারী নীতিমালা সময় সাপেক্ষ ও জটিল হওয়ায় সেটি প্রায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে ওঠে। পর্যাপ্ত জনবল, আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাসহ প্রয়োগধর্মী জাতীয় স্বাস্থ্য গবেষণা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও কর্মসূচী, সেবা প্রদান ও গরিববান্ধব নীতিমালা প্রণয়ণ এবং গবেষণার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন বিঘ্নিত হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থাপনা উন্নত করার উদ্দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার এখনও যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য জনশক্তির আগ্রহ ও দক্ষতার অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অপ্রতুলতা বেশ দৃশ্যমান। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ওষুধ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা, জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা ও প্রশাসনের জটিলতা এবং সুসংগঠিত রেডারেল পদ্ধতি না থাকায় স্বাস্থ্য অবকাঠামোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সৃষ্ট বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার দিক দিয়ে সন্তোষজনক নয়। স্বাস্থ্যসেবার পূর্ণতা অর্জনের জন্য সরকারী এবং বেসরকারী খাতে অর্থের সঙ্কুলান ও ব্যবস্থাপনা অপর্যাপ্ত। এতে দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশ এখনও বিভিন্ন জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগ কেন্দ্রিক। উপজেলা পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। জটিল অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের মাত্রাও অনেকগুণ বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও অনেক বেড়েছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি এবং ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর। আবার কিছু ক্ষেত্রে স্থবিরতার লক্ষণ দৃশ্যমান। সুস্বাস্থ্য এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে বস্তিবাসীদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। বেসরকারী হাসপাতালের ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারে না অধিকাংশ সাধারণ মানুষ। সরকারী স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পৃক্তদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার বিষয়টি দীর্ঘ বছর ধরে বেশ আলোচিত হয়ে আসছে। বর্তমান সরকারও এ সমালোচনা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বর্তমান সরকারও স্বাস্থ্য সেক্টরকে দুর্নীতি ও দলীয় লোকজনের অহেতুক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে পারেনি। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির অনেক ঘটনায় অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে । স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, থানা ও জেলা পর্যায়ে কম খরচে জটিল রোগের চিকিৎসার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে দরিদ্র মানষ উপকৃত হতো। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার জন্য ব্যয় করতে হতো না। মানসম্মত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সেবাদানকারীদের মন-মানসিকতার ওপর নির্ভর করে। মানসম্মত সেবাদানের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা না থাকলে ভাল স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব না। স্বাস্থ্য সেক্টরের উন্নয়নে বর্তমান সরকার বহুমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছে। জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কয়েকটি বিষয় চিহিৃত করেছে। সেগুলো হচ্ছে সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও সেবার দুর্বল গুণগতমান। আর সেবা গ্রহীতার তথা চাহিদার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের অসামর্থ্যতা, জ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী জীবন-যাপন পদ্ধতি অনুসরণ না করা। সুস্বাস্থ্য এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে বস্তিবাসীদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগের সক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের ভূমিকা এখনও পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট জনশক্তির দক্ষতা সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে মানসম্মত প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে অন্তরায় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। কারণ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, আরও কিছু মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে জনবল বাড়াতে হবে। আর বর্তমান সরকারের ইতোমধ্যে গৃহীত ও চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্য সেক্টরের বাজেট বৃদ্ধি করা দরকার। আর তৃণমূল পর্যায়ে যারা কাজ করবেন, তাদের জন্য উৎসাহ ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত মনে করেন বিএমএ মহাসচিব। স্বাস্থ্য অধিদফতর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা কয়েকগুণ বেড়েছে। অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় কোন জাতীয় দিক নির্দেশনা নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে নেই কোন ব্যবস্থাপনা। প্রথমবারের মতো এ জাতীয় রোগ নিয়ে বিশেষ গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এ জাতীয় রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে বিশেষ কার্যক্রম সাজাতে গিয়ে পদে পদে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সংক্রামক রোগ ধীরে ধীরে কমছে, দ্রুত বাড়ছে অসংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয় দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর অনেক অসংক্রামক রোগের শতভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই অনেক অসংক্রামক রোগীকে চিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশের শতকরা ৬১ ভাগ রোগই হচ্ছে অসংক্রামক রোগ। ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব জনকণ্ঠকে জানান, জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বিদ্যমান জন স্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্টি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আর প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাড়বে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মাত্রা। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হবে মানুষ। চলমান জন স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। ওই অবস্থার জন্য থাকতে হবে বাড়তি প্রস্তুতি। কিন্তু ওই ধরনের প্রস্তুতি নেই বাংলাদেশের। বর্তমান জন স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। যেখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন রশিদী-ই মাহবুব। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জনবল বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি সরকারী চিকিৎসা সেবায়। সরকারী হাসপাতালে জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিনা মূল্যে চিকিৎসা প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেই বেসরকারী চিকিৎসাসেবা। দেশের অধিকাংশ মানুষ বেসরকারী হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না। অসুস্থতার চিকিৎসা করাতে গিয়ে দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। সরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ সঙ্কুচিত করে তুলছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। আর এমন অবস্থায় দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ধনী সব শ্রেণীর মানুষের জন্য ন্যূনতম মানসম্পন্ন সেবা প্রদান জরুরী হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক কোন নীতিই বাস্তবে কার্যকর করে তুলতে পারেনি সরকার।
×