ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র বিশ হাজার টাকার জন্য গৃহবধূকে হত্যার চেষ্টা পাষন্ড স্বামীর

প্রকাশিত: ০৫:০১, ৬ এপ্রিল ২০১৮

মাত্র বিশ হাজার টাকার জন্য গৃহবধূকে হত্যার চেষ্টা পাষন্ড স্বামীর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ মাত্র বিশ হাজার টাকার জন্য নববধূ মুন্নীকে গ্যাসের চুলার আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে এক পাষন্ড স্বামী। অতি দরিদ্র ওই নববধূ মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে জীবনের সঙ্গে লড়ছেন। তার বুকের স্পর্শকাতর অংশ ও পেট মারাত্মক দগ্ধ হয়েছে। যা দেখলে যে কারো গা শিউরে উঠতে বাধ্য। যন্ত্রণায় পাগলের মতো আচরণ করছেন ওই গৃহবধূ। মায়ের মতো তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের কুমিল্লার সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি এ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা। ওই গৃহবধূকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আনা থেকে সমস্ত চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করছেন তিনি। ইতোপূর্বে এই মহিলা এমপি রাস্তায় পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে নিজের গাড়িতে করে তুলে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন। তাকে নিজ টাকায় চিকিৎসা করে বাড়ি পাঠিয়েছেন। পরে জানা যায় ওই ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা। ঘটনাটি ওই সময় ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, পঞ্চম তলার বারান্দায় বসে যন্ত্রণায় চিৎকার করছেন মুন্নি আক্তার (১৬) নামের ওই গৃহবধূ। একটি মাত্র পাতলা ওড়না দিয়ে তার শরীর ঢাকা। পাশেই বসে অঝোরে কাঁদছেন একমাত্র মেয়ের মা লাইলী আক্তার। যন্ত্রণায় আবোল-তাবোল বকছিলেন। যন্ত্রণায় কারণ জানার চেষ্টা করলে নববধূ ওড়না সরিয়ে ক্ষতস্থানের খানিকটা দেখানোর চেষ্টা করেন। খানিকটা দেখার পর আর তাকিয়ে থাকা যাচ্ছিল না। এতটাই বিভৎসভাবে তাকে পুড়ানো হয়েছে যে, কারও পক্ষেই তা তাকিয়ে দেখা সম্ভব নয়। ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইতেই মুন্নির মা লাইলী আক্তার বলছিলেন করুণ সেই কাহিনী। যা গল্পকেও হার মানায়। বলছিলেন, আমরা চাঁদপুর সদর জেলার মনিনাগ হাওলাদার বাড়ির বাসিন্দা। আমার স্বামীর নাম আব্দুল লতিফ। তিনি হার্টের রোগী। ভারী কাজ করতে পারেন না। করলে বুকে ব্যথা হয়। চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই। একমাত্র ছেলে দুলাল ঢাকায় একটি খাবার হোটেলে মেসিয়ারের কাজ করে। ছোট মেয়ে মুন্নি। আমাদের নিজস্ব কোন জায়গা বা বাড়ি নেই। মাসিক চার হাজার টাকায় একটি বাড়িতে ভাড়া থাকি। স্বামীর তেমন কোন রোজগার নেই। তাই নিজে মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করি। ছেলে আর আমার রোজগারে সংসার চলে। প্রায় তিন মাস আগে একই এলাকার হাজীগঞ্জের রায়চর নোয়াট এলাকার ভূইয়া বাড়ির ছেলে সোহাগের (৩০) পরিবারের তরফ থেকে বিয়ে প্রস্তাব আসে। মেয়ের বয়স আরেকটু হলে বিয়ে দিবেন বলেন তারা জানান। কিন্তু অভাবের সংসারে এমন প্রস্তাবও ফেলতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত সোহাগের সঙ্গে বিয়ে দেই। বিয়ের সময় ব্যবসার কথা বলে সোহাগ ৬০ হাজার টাকা নেয়। বিয়ের পর মুন্নিকে তিন মাস পর আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়। সেই কথামতোই মেয়ে আমার কাছেই থাকে। সোহাগ নিয়মিত আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতে থাকে। মাস খানেক আগ থেকে সোহাগ ব্যবসার কথা বলে আরও ২০ হাজার টাকা চায়। এরপর আর কথা বলতে পারছিলেন না মুন্নির মা। কেঁদে কেঁটে একাকায় বলছিলেন, আমরা জামাইকে বুঝাই। বাবা আমরা গরিব মানুষ। আমাদের কাছে আর কোন টাকা নেই। কিন্তু জামাই প্রায়ই টাকা চাইতে থাকে। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি চলছিল। এরই মধ্যে গত শুক্রবার জামাই আসে। যথারীতি রাতে থাকে। সকালে আমি অন্যান্য দিনের মতো মেয়ে আর জামাইকে রেখে অন্যের বাড়িতে যাই কাজ করতে। দুপুর বারোটার দিকে বাড়িতে ফিরি। বাড়ির দরজা সামনের দিকে লাগানো। ভাবলাম মেয়ে আর জামাই হয়ত ঘরে ঘুমিয়ে আছে। তাই আস্তে আস্তে ডাকতে থাকি। বার বার ডাকাডাকির পরেও কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। এরপর মনের মধ্যে খটকা লাগে। কি ব্যাপার! অনেক ডাকাডাকির পরও সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘরের পেছনের দিকে থাকা দরজার কাছে যাই। দেখি সেই দরজা বাইর থেকে আটকানো। খুলে ঘরে গিয়ে মেয়েকে রান্না ঘরে গিয়ে অচেতন অবস্থায় বেহুশ হয়ে পড়তে থাকতে দেখি। তার পেট, বুকের স্পর্শকাতর অংশ, জামাকাপড়, পিঠের অনেকখানিক পুড়ে গেছে। পরে মেয়ের কথাবার্তায় বুঝতে পারি, টাকা নিয়ে ঝগড়ার একপর্যায়ে সোহাগ তার মেয়ের মুখ চেপে ধরে গ্যাসের জ্বলন্ত চুলার ওপর ঠেসে ধরেছিল। মেয়েকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিলে আশপাশের মানুষ মুন্নিকে উদ্ধার করে কুমিল্লা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা চলতে থাকে। আস্তে আস্তে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। এরপর সেখানকার চিকিৎসকরা মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। টাকা না থাকার অভাবে ঢাকা আনতে পারছিলাম না। এরই মধ্যেই কিছু লোক হাসপাতালে গিয়ে তার খোঁজ করে। পরে জানতে পারি তারা মহিলা এমপি মুক্তার লোকজন। পরে তারাই আমাকে ঢাকায় এনে ভর্তি করে। তিনিই চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছেন। এমপি নিজেও তার মেয়েকে দেখে গেছেন। বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ডাঃ সামন্ত লাল সেনসহ বড় বড় ডাক্তাররা এসে মুন্নিকে দেখে গেছেন। তাদের চেষ্টায়ই তারা বিছানা পেয়েছেন। চিকিৎসাও চলছে ভালোভাবে। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, মেয়েটির বুকের স্পর্শকাতর অংশের অনেকখানি এবং পেটের প্রায় পুরো অংশ পুড়ে গেছে। তার সবোর্চ্চ উন্নত চিকিৎসা করা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়াও আর্থিকভাবে মহিলা এমপি এ্যাডভোকেট নুরজাহান বেগম মুক্তা মুন্নির চিকিৎসায় সহায়তা করছেন। মুন্নির চিকিৎসায় এগিয়ে আসার বিষয়ে মহিলা এমপির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, অসহায় মানুষদের সহায়তা করতে পারলে, সত্যিকার অর্থেই আমার ভালো লাগে। শুধু আমার নয়, আমার ধারণা সমাজের প্রতিটি মানুষের অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তা করতে পারলে ভালো লাগে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিভাবে তিনি মুন্নির খবর পেলেন সে বিষয়ে তিনি বলছিলেন, ঘটনাটি কুমিল্লার কিছু স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এরপর আমি আমার লোকজন দিয়ে মুন্নি ও তার পরিবারকে খুঁজে বের করি। তারপর মুন্নিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসি। মুন্নির চিকিৎসার জন্য যা প্রয়োজন সব আমি করতে প্রস্তুত। মুন্নি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেই আমার শান্তি। একজন অসহায় মানুষকে সহায়তা করার কি যে শান্তি! যিনি করেন একমাত্র তিনিই বুঝতে পারেন। এটি বলে বুঝানো যাবে না। সত্যিকারের মনের তৃপ্তি। মুন্নির স্বামীসহ এ ধরনের পৈশাচিক ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। এমনটা দাবি করেছেন, মুন্নির মাও।
×